নিমিষে নি:শেষ

নিমিষে নি:শেষ

শেষ জাদুর কাঁঠিটা প্রায় শেষের পর্যায়ে। জাদুর কাঁঠি মানে সিগারেট। লগারিদমের খাতাটা পেন চাপা দিয়ে বন্ধ করে সিগারেটের নাম সিগারেট কেনো,সেটা নিয়ে ভাবনা শুরু। পড়ালেখার জিনিস ছোটবেলায় উল্টিয়ে রাখতাম না। কেউ বলেছিল, “উন্টায়া না রাখিলে,শয়তান পড়িয়া ফেলায়।” তখন থেকে উল্টে রাখি। অভ্যাস হয়ে গেছে।

সিগারেটের মানে ভাঙতে লাগলাম। সিগারেটের সি = 011 গা = 101……আমি Math এর টিচার ওরফে ভাইয়া। ভাঙা-ভাঙি টা বাইনারিতেই করি। জীবনে একটা প্রেম করেছি। বাইনারি এক্সাম এর আগের রাতে ওই relation ভেঙে গেছে। সেই নিয়ে দু:খ নেই। যাই হোক,মুখে সিগারেট তখন থেকেই আমন্ত্রণ পত্র পেয়েছে। ছ্যাঁক খাওয়ার জন্য সিগারেট খাওয়া না,ইহা উদযাপন করার জন্য খাওয়া।

হঠাত চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেলো। আমি থাকি আট তালাতে। নিচে বাচ্চাদের চিল্লাচিল্লি শুনতে পেলাম। নিচের বাচ্চা কলোনিটা অনেক মজার। সেদিন এক সপ্তাহের বাজার একবারে করে এনে গেইট এ ঢুকছি। এক বাচ্চা বলে,”আজকে রাতে কি
party হবে?” আমি একটু চমকে উঠলাম। তারপর একটা হাসি দিয়ে বাসায় ফিরলাম। এখন কার দিনের বাচ্চাদের এতোগুলা জিনিস মানেই party. এতোগুলা প্রেম = party,এতোগুলা ব্রেকআপ = party,এতো গুলা সিগারেট = party.

উফফ!সিগারেটের ছ্যাঁক হাতে লাগলো। তন্দ্রা ভাঙলো। বাচ্চাদের চেঁচামিচি এখন বন্ধ। তবে,মাঝেমাঝে কিছু বাচ্চা হাঁক দিয়ে উঠছে। আমি পেছন ঘুড়ে তাকালাম। বাইরে জোছনা নেই। অন্য ফ্ল্যাটের আলোগুলো ভেতরে আসছে। তবে,খুব ই অল্প পরিমাণ এ। একটা চুপচাপ ভাব কাজ করছে। যেনো ঝড় এসে,চলে গেছে। অথবা আসবে। বুঝে উঠলাম,কারেন্ট নাই। 

আমার কাছে মোমবাতি নাই। কখনো প্রয়োজন পরেনি রাখার। সিগারেট টা শেষ হয়েছে। হাত দিয়ে মোবাইলটা খুঁজতে লাগলাম। অন্ধকারে খুব অসহ্য লাগছে। এর পরের দিন থেকে,চোখ বন্ধ করে হাঁটার practice করবো। কাজে দিবে। গরমে গা পুড়ে যাচ্ছে। উপলব্ধি করা শুরু করলাম,সারাদিন গা পুড়িয়ে যেসব অন্ধ মানুষ জ্যাম হলে আমি বসে থাকা CNG টাতে ছুঁটে আসে টাকার জন্য তাদের অনুভূতি কেমন হয়। না,ব্যাপার টা কর্কশ। ভাবা অহেতুক। ঘামছি। পরিমানটা একটু বেশী। চোখটাও জ্বলছে। দুইদিন আমি নির্ঘুম আছি। নতুন একটা experiment করছি। হ্যালোশিনেসন করার try করছি। তিন দিন টানা না ঘুমালে হ্যালোশিনেসন হয়। আমার বিশ্বাস,আমার ক্ষেত্রে ইহা দুইদিনেই সম্ভব। হ্যালোশিনেসন হলে কাছের মানুষদের দেখা যায়। আমিও কাউকে দেখতে চাই।

মোবাইলটা পেলাম। Flash Light টা জ্বালালাম। আলোটা অল্প। তবে আনন্দদায়ক। কখনো আলোর কাছ থেকে আনন্দ পাইনি। এখন পাচ্ছি। ভালো লাগছে।
বড় আপার বাবু হবে। জমজ বাবু। আপাকে বলতে হবে,একটার নাম আলো আর একটার নাম আনন্দ রাখো। আগে পিছে নিজের মতো লাগিয়ে নাও। তোমাদের সন্তান। মামার কাজটুকু আমি করলাম,ওদের ডাক নাম দিলাম। মামারা ডাক নাম দেয়। আমার পলাশ নামটা বড় মামার রাখা। উনার চেহারা নূরানি চেহারা। এই অন্ধকার ঘরে উনি থাকলে কোনো বিদ্যুৎ লাগতো না। তবে বাতাসের অভাব কিভাবে মেটাতাম সেটা ভাবা লাগবে। আমার ফ্ল্যাটটা ছোট। একা থাকি,বড় বাসার প্রয়োজন নেই। ঘর থেকে পা বাড়ালেই dining room. বাসায় নূপুর পড়ে হাঁটাহাঁটির কেউ নেই। এমন কেউ থাকলে হয়ত শোবার ঘর থেকে খানিকটা দূরে অন্য রুমগুলোর ব্যবস্থা করা লাগতো। সে পায়ে নূপুর লাগিয়ে ঝনঝন করে হেঁটে যেতো অন্য রুমে,আওয়াজটা শুনতে ভালো লাগতো। Dining room এ ফ্রিজের উপর একটা charger আছে। পেয়ে গেলাম এবংজ্বালালাম। 

আলো টা খুব অল্প। একে এর ন্যায্য অধিকার দেয়া হয়নি। অনেক দিন charge এ দেয়া হয়নি। মানুষ হলে,খাওয়ার জন্য হুড়োহুড়ি লাগিয়ে দিতো। এটি জড় বস্তু। জড় বস্তু শান্ত থাকে। কথা না বললে,কেউ দাম দেয় না। তবে,Anderson Hypes এর মতবাদ আমাকে নাড়া দিয়েছে,”জড় বস্তু শান্ত সময় শান্ত থাকলেও পরিবেশ অশান্ত থাকলে,ইহাও অশান্ত হয়ে যায়।” ঘটনা সত্যি।
আমি charger টা জ্বালিয়ে ঘরে আসলাম। বারান্দার দরজাটা দিয়ে বাতাস ঢুকছে। হিমালয়ের গা লেগে আসা বাতাস বুঝায় যায়। বেশ ঠান্ডা। বৃষ্টি হতে পারে। তবে,আজকের বৃষ্টিতে আমার কিছু যায়-আসে না। আমরা মানুষ। যাওয়া-আসার হিসেব আগে করি। যেহেতু মানুষের জীবনটা যাওয়া-আসার মধ্যে আটকিয়ে থাকে,তাই এইটা নিয়েই হিসেব করা উচিত। আমরা সেটা ভালো বুঝি। এই কারণেই হয়ত আমরা আশরাফুল মাখলুকা। তবে,এই নিয়ে আমার গর্ব করা সাজে না। নামায ঠিকমতো পড়া হয়না। ‘সৃষ্টির সেরা জীব’ শব্দটার থেকে ‘সেরা বান্দা’ শব্দটা বেশী কানে বাজে।
বাতাস আমার ঘরের পর্দা টা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। পরীক্ষা খারাপ হলে জীবনটা যেমন এলোমেলো মনে হতো,সেই রকম। পর্দা জড় বস্তু। পরিবেশ অশান্ত হলে,পর্দাও অশান্ত হবে এইটাই স্বাভাবিক। অনেকক্ষণ ধরে পর্দার ওপাশে কিছু ছায়া আমি উপলদ্ধি করছি। মাথায় নি নাই। Charger টা ফ্রিজের উপর জ্বালিয়ে রেখে এসেছি। উইপোকা তার মাথার উপর ঘোরাঘুরি করতে পারে। আর বিজ্ঞান যদি ভুল না করে থাকে,তবে তার ছায়া floor এ পরতেই পারে। অন্ধকারের কারণে ছায়াটা বড় মনে হচ্ছে। Charger টার সামনে এখন একটা লবণ দানা ধরলেও তা বাক্সের সমান লাগবে। এইটা অস্বাভাবিক কিছু না। 

হঠাত পর্দা দুইটা সরে গেলো। না,সরিয়ে দেয়া হলো। আমার বড় মামা ঘর এ প্রবেশ করলেন। আমি বিচলিত নয়। দুটি কারণ,প্রথমত উনি আমার পরিচিত মুখ। কোনো মৃত পরিচিত মুখ দেখে ভয় পাওয়ার কিছুই নাই। দ্বিতীয়ত,উনার চেহারা নূরানি চেহারা। ঘরে আলো ফিরে এসেছে। তাই একটু শান্তি লাগছে। শান্তিতে থাকলে মানুষ বিচলিত হয় না। তবে,কিছুটা গরম লাগছে। এমতাবস্থায় বাতাসের ব্যবস্থা কিভাবে করা যায় তা নিয়ে পরে ভাবতে হবে। মামা খাটে বসলেন। আমি পেছন ঘুরলাম। মামার চোখ জ্বলজ্বল করছে। হরিণের চোখের মতো। একটা লেখা মনে পড়ছে,’জ্বলন্ত হরিণ চোখ,ভিত হয় ভীতু লোক।’ মামার আওয়াজ মোয়াজ্জিনের মতো। কিছুটা চিকন,পুরোটা মধুর।মামা বললেন,
“তোর অবনতি চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে এসেছি।”
“মামা আপনি যে সত্যি সত্যি আসেননি,সেইটা আমি জানি।”
“কি বলতে চাস?”
“কিছু বলতে চাই না। আল্লাহ মাফ করুক। প্রথম কথা সালাম দিয়ে হওয়া উচিত ছিলো। আসসালামুয়ালাইকুম।”
“ওয়ালাইকুমাসসালাম। সালামের মানে জানা আছে?”
“জ্বি। আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক।”
“হুম। সিগারেট টা কবে ছাড়বি তুই?”
“আপনি বললেই ছেড়ে দেবো।”
“আমি বললাম,ছেড়ে দে।”
“জ্বি,কালকে একটা দামী সিগারেট খেয়েই ছেড়ে দেবো। শেষ সিগারেট টা কম দামী হলে অপমানিত বোধ হবে।”
“কথা দিতে বলবো না তোকে। তোকে আমি চিনি। তুই ছাড়বি জানি। বাসায় পানি আছে?”
“মামা,আপনি কি অজু করবেন?”
“না,খাবো।”
“আপনাকে পানি দিয়ে লাভ নেই। আপনি আসল না। আপনি আমার হ্যালোশিনেসন। মৃত্য ব্যক্তি দেখতে পাওয়া হ্যালোশিনেসন এর প্রথম পর্যায়। ‘হ্যালোশিনেটেড অবজেক্ট কোনো কিছু খেতে না পান করতে পারে না।’ John Abram এর বই। পৃষ্ঠা 15.”

“তুই একটু বেশী বুঝিস। সেই কারণেই মাস্টার হয়েছিস। তোর বাপও বেশী বুঝতো। বেশী বোঝা মানুষ মাস্টার হয়।”
“রাগ করবেন না,মামা। আপনি রাগলে আপনার মুখ লাল হয়ে যায়। লাল হওয়া মুখ দিয়ে আরো বেশী আলো বের হয়। বেশী আলো ভালো না। চোখের রেটিনা ভেদ করে মার্গুলাস মাশল এ attack করে। ইহা চোখের চশমা লাগানোর একটি কারণ।”
“তুই আবার পটরপটর করছিস?”
“হ্যালুশিনেটেড অবজেক্ট কে বিরক্তির মধ্যে রাখা উচিত।”
“তুই কি চাস,আমি চলে যাই?”
“না। আমি চাই কারেন্ট আসুক। গরম ভালো লাগছে না।”
“তোকে কিছু কথা বলার জন্য এসেছিলাম। এক কাপ চা দে,খেতে খেতে কথা বলি।”
“মামা,আপনি কিছু খেতে পারবেন না। খেতে যাবেন,ওমনি vanish হয়ে যাবেন। আপনাকে দেখতে ভালো লাগছে। Vanish হওয়ার প্রয়োজন নেই। কথা বলুন। আমি শুনি।”
“তুই গ্রামে কতদিন ধরে যাস নি?”
“৮ মাস।”
“কেনো যাসনি?”
“আপনি আমার কাছের ছিলেন। আপনি মারা যাওয়ার পর,আর যাওয়ার interest পাইনি।”
“তোর মা রোজ কাঁদে।”
“জানি। মাকে কষ্ট দেয়া উচিত নয়। তবে,ছুটি পাইনা। পেলেও অন্য কাজে জড়িয়ে পড়ি। টাকা রোজগার এখন না করে আবেগাপ্লুত হলে চলবে না। আবেগ কখনো খেতে দেয়না। লেখকরা আবেগ বেঁচে খাওয়া-দাওয়া করে। আমিও লেখক। তবে,white board এ লিখি। আমার জীবন লগারিদম আর বাইনারির মাঝখানে পড়ে থাকা কোনো এক সিগারেটের ঝলসানো তামাক পাতার মধ্যে আঁটকিয়ে আছে। আবেগ দিয়ে আমার কাজ নেই। ভালো অবস্থায় যাই,মাকে নিয়ে আসবো।”

“শুনে ভালো লাগলো। তোর বোন আলেয়ার জমজ বাচ্চা হবে। ওরা ওদের নাম আলন্দ আর আলো রাখবে বলে ঠিক করেছে। কিছু জানিস? নাম দুইটা আমার পছন্দ হয়নি। আলো-বাতাস,আল্লাহর তৈরী। ওইসব জিনিস কোথায় কিভাবে লাগাতে হবে,আল্লাহ ভালো জানেন। মানুষের উচিত আল্লাহ নামে নাম রাখা। কি বলিস?”

“পরশু দিন কথা হয়েছে। তবে,নামের ব্যাপারটা জানি না।”

“পারুল বিয়ে করতে চাইছে না। আমি মারা যাওয়ার পর,ওর মায়ের কথা শুনে না। তুই বুঝা।”

“পাত্র কি ঠিক?”

“না,এই কাজটা তোর। তুই ওর ভাই। মামাতো ভাই ও আপন ভাই হয়।”

“জ্বি,আমি কথা বলবো। মামা,বেয়াদবি মাফ করবেন। আপনার পাঞ্জাবিটা নোংরা মনে হচ্ছে। আমি কি ধুয়ে দেবো?”

“তুই কি আমাকে সত্যি ভয় পাচ্ছিস না?”

“না,মামা। পেলে কথা বলতাম না। শুধু চিতকার করতাম। ভয়ে মানুষ দুটো জিনিস করে। হয়তো,বোবা হয়ে যায় নাহলে চিতকার শুরু করে।”

“আবারো পটরপটর করছিস। পানি দে তো।”

“মামা,আপনি কি যেতে চান?”

“হ্যাঁ,এখন যাওয়া উচিত। তোকে একটা কথা বলি। ভাববি কম,করবি বেশী।”

“জ্বি,আচ্ছা।”
আমার চোখ খুব জ্বলছে। চোখ চুলকালাম। মামা নেই। অনেক বাতাস গায়ে লাগছে। হিমালয়ের গা ঘেষে আসা বাতাস না। কৃত্রিম পবন। কারেন্ট এসেছে। আমি মনে মনে অনেক খুশি। ‘সিগারেট’ শব্দটার মানে বের করেছি। সিগারেট প্রথম মায়ান সভ্যতায় দেখা দিয়েছিলো। মায়ান অভিধানে সিগারেট মানে ‘নিমিষে নি:শেষ।’ এর ছোট size এর জন্য এমন নামকরণ। তবে,এর টানে আমাদের জীবন নিমিষে শেষ হয়ে যাওয়ার পথে এক ধাপ এগুচ্ছে,এইটাও ঠিক। পকেটে বেশী টাকা নেই। কালকে দামীটা খাওয়া যাবেনা। অনেক মানুষের আমাকে দরকার। অকালপক্ক আর অকাল মৃত্যু ভয়ানক ব্যাপার। যার হয়,সে আশেপাশের সাবাইকে বিপদে ফেলে দেয়।

আমি উঠে dining room এ গেলাম। এক গ্লাস পানি মেঝেতে পড়ে আছে। কাঁদার ছাপ,পায়ের আকৃতির। মামার পা,বোঝা যায়। বেশ ভরাট। হ্যালোশিনেসন মাঝেমাঝে অনেক বেশী সত্যি মনে হয়। কলিংবেল টা বেজে উঠলো। আসগর সাহেব পাশের বাসা। উনি মুখ ভেতরে ঢুকিয়ে কি যেনো দেখলেন। তারপর বললেন,
“আপনার বাসায় কারেন্ট আছে,আমাদের বাসায় নেই কেনো।”

“Cut out এর প্রব্লেম হবে হয়ত।”

“জ্বি,না। আমাদের বাসায় নেই মানে,পুরো এলাকা তেই নেই। আপনি কি IPS চালান?”

“জ্বি,না। পাওয়ার গ্রিডে সমস্যা হতে পারে। আমার খুব কাছের বন্ধু সাভার পাওয়ার গ্রীডে কাজ করে। BCS পরীক্ষায় আমার দেখে পাশ করেছে। ও আমার কাছে চিরকৃতজ্ঞ। আমার পা ধুয়ে বোতলে করে পানি নিয়ে যেতে চায়। বলে,হাফ গ্লাস ও খাবে আর হাফ গ্লাস ফ্রিজে রাখবে। ওর কাজ হয়ত এইসব। আমি যেনো কষ্ট না পাই,তাই আমার বাসায় রেখে বাকিগুলা টেনে নিয়েছে।”
লোকটা বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে। মানুষকে বিস্মিত করতে ভালো লাগে। গায়ের ক্লান্তি ঝরে যায়। উনি হয়তো বিলাপ বকছেন। আমি শুনিতে পারছি না। দরজা লাগিয়ে ভেতরে আসলাম। বিছানার চাদরটা ভাঁজ ভাঁজ হয়ে আছে। ঠিক না করে,গা টা এলিয়ে দিলাম। আজকে একটু ঘুমানো উচিত।

রাত্রীর যাত্রী

রাত্রীর যাত্রী

“আপনি কি ভূত ভালোবাসেন?”
আমি লোকটার দিকে তাকালাম। কালো রঙের প্যান্ট পরা,সাদা চেকচেক শার্ট। শার্ট প্যান্টের ভেতর গুঁজে রাখার জন্য তৈরী হয়েছে। উনি গুঁজে রাখেন নাই। গা থেকে কড়া এক সিগারেটের গন্ধ বের হচ্ছে। তবে,গন্ধটা ভালো লাগছে। উনি শ্যামলা, কিন্তু মুখে সাবান মেখে যত্ন কম নেন হয়ত।
মনে মনে ভাবতে লাগলাম,ভূতও কি ভালোবাসার জিনিস? প্লাটফর্ম এর মর্চে ধরা লাল বেঞ্চিটাতে আমার সাথেই বসা। সিলেট যাওয়ার জন্য ট্রেন এর অপেক্ষায় দেড় ঘন্টা ধরে এইখানেই বসে আছি। ইনাকে তো দেখি নি। উনি হাঁক দিয়ে উঠলেন।
“জ্বি,আপনাকেই বলছি। সিগারেট খান?”
বিস্ময় নিয়ে জবাব দিলাম
“একটু-আধটু।”
উনি একটা সিগারেট দিলেন। আমি নিচ্ছিনা। উনি আমার জবাবের অপেক্ষায় আছেন। আমি জবাব দিলাম,
“আমি দুপুরে খাওয়ার পর একটা খাই আর রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে একটা খাই। এর মাঝে খাই না।”
উনি কিছুটা অবাক হলেন। মানুষকে অবাক করা জবাব দিতে ভালো লাগে। সিলেটে ফুপা মারা যাওয়ার খবরে মনটা খারাপ ছিলো এখন ভালো লাগছে। উনি বলে উঠলেন,
“আপনি সিগারেট খান,নাকি ঔষধ খান? অভ্যাস পাল্টান। ভদ্রতার খাতিরে হলেও অভ্যাস শিথিল করা উচিত।”
আমি হাতের পেপারটা গোল করে ভাঁজ করতে লাগলাম। উনি আবার বললেন,
“আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম। ভূত ভালোবাসেন?”

“ভূত কি ভালোবাসার জিনিস?”

“দেখুন মানুষের ভালো লাগা অনেক ধরনের। আমার এক বন্ধু আছে। ওর প্রিয় জিনিস মরা মানুষ। লাশ বেচাকেনার ব্যবসা করে। দুইবার ধরাও খাইসে। ওরে পুলিশ পিটিয়ে লাশ বানাইতে পারে নাই। লাশ দেখে দেখে নিজে শক্ত হয়ে গেছে। অদ্ভুত কিসিম এর মানুষ। কিসিম আর কিসমিস,দুটোই আমার খুব প্রিয়।”
উনি এক নাগাড়ে বলে গেলেন,আমিও এক নাগাড়ে শুনে গেলাম।

“আপনার কেনো মনে হলো আমি ভূত পাগল মানুষ?”

“হতেই পারেন। ভালোবাসা মানে লুতুপুতু ভালোবাসা না। ভয় পাওয়ার মধ্যেও ভালোবাসা থাকে। মানুষ ভূত ভয় পায়। কেউ যদি বলে সে ভূতে ভয় পায়না,আমি এই সিগারেটের প্যাকেটের কসম খেয়ে বলতে পারি তার সামনে ভূতের কাহিনী বললে সে ভয় পাওয়ার স্বরূপ তার পায়ের বুড়ো আঙুলটা একটু হলেও নাড়াবে। আমার একটা উক্তি আছে,ভূতে ভয় করে যেইজন সেইজন সেবিছে ভূতপ্রেমিক।”

“প্যাকেটের কসম খেলেন। ঘটনা যদি মিথ্যা হয়?”

“মিথ্যা হলে এই রাতে একটু পর বৃষ্টি নামবে,আমি ভিজে যাবো। তার সাথে আমার সিগারেটের প্যাকেট টাও বিড়াল-কুকুরের মতো ভিজবে।”

উনি হয়ত “It is raining cats and dogs” বাক্যটা কোথাও শুনেছেন। বাক্যের সাথে মানের মিল না খুঁজে পাওয়ায় উনি বিস্মিত। তাই নিজের মতো করে বিড়াল-কুকুর বলে চালিয়ে দিলেন।
আবারো উনার আওয়াজ শুনলাম,
“সিলেটের ট্রেন তো লেইট? আমি মোতালেব। বালুর ব্যবসা করি। ব্যবসা করি আর জোঁকের কামড় খায়। হে হে।”
উনার হাসিটা অদ্ভুত রকমের খারাপ। বালুর ব্যবসার সাথে জোঁকের কামড় কিছুটা মিলাতে পারেছি। আমি বললাম,
“আমিতো আপনাকে বলি নাই আমি সিলেট যাবো।”

“এই স্টেশনে রাতের শেষ ট্রেন সিলেট এর। আপনাকে বেঞ্চে শুয়ে থাকা মানুষ এর মতো মনে হয় না। তারমানে আপনি যাত্রা করবেন। আর,যাত্রা করলে সিলেট এই যাবেন।”
মেঘ ডাকছে। আমি মনে মনে ভাবছি বৃষ্টি আসলে,ভালো হবে। তাড়াহুড়ো করতে যেয়ে গোসলটা করা হয়নি। বৃষ্টি পরিবেশ ঠান্ডা করে। সারাদিন গোসল না করা মানুষ সেই ঠান্ডা পরিবেশ উপভোগ করে। যদিও মাথা ব্যথা শুরু হয়। তার পরেও উপভোগ যোগ্য। উনি আবার সাড়া দিলেন,
“বৃষ্টি আসবে না। আমি বাজি ধরতে পারি।”

“যদি আসে?”

“আসলে আপনাকে একটা কেরামতি দেখাবো। বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে ভেজা ম্যাচ দিয়ে একটা ভেজা সিগারেট জালিয়ে খাবো। দুই টানে শেষ করবো। দুইটানে সিগারেট শেষ করলে,মাথা চিনচিন করে। এমন অনুভূতি আছে?”

“আমি তৃপ্তি নিয়ে সিগারেট খাই। এমন অনুভূতি নেই।”

“আজকে তাহলে দেখবেন কেরামতি। বৃষ্টি আসলেই দেখতে পাবেন।”
বৃষ্টি নয়,ট্রেন আসছে। আমি উঠে দাঁড়ালাম। ব্যাগটা নিলাম। উনিও উঠে দাঁড়ালেন।
“আপনার সাথে কথা বলে ভালো লাগলো। যাত্রা শুভ হোক। ট্রেনে যাত্রার আগে কলা খাওয়া উচিত। যাত্রা শুভ আর অতি দ্রুত হয়। একটাও দোকান খোলা নাই,নাহলে কলা খেতে বলতাম।”

আমি জবাব দিলাম,
“জ্বি,ধন্যবাদ।”
ট্রেনের আলো স্টেশনের পিলার গুলোতে বাড়ি খাচ্ছে। ট্রেনটা প্রায় চলে এসেছে। এইসময় হঠাত বৃষ্টি শুরু। আমি পাশে তাকালাম। দেখলাম লোকটা নাই। ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আমি প্রায় ভিজে যাচ্ছি। নিচে তাকিয়ে দেখি সিগারেটের প্যাকেট আর ম্যাচের বাক্স পড়ে আছে। সেগুলো অসহায়ের মতো ভিজছে। বৃষ্টিতে বিড়াল-কুকুর ভিজলে যেমনটা লাগে,সেরকম লাগছে।
আমি ছুটে ট্রেনে উঠলাম। আর ভেজা যাবে না। সিটটা খুঁজে বসে পড়লাম। রুমালটা খুঁজে পেলাম না। ট্রেন চলা শুরু করলো। জানালা দিয়ে চোখটা বাইরে গেলো। মোতালেব সাহেব মেঝেতে বসা। তিনিও ভিজছেন। হাতে একটা সিগারেট। তিনি ভিজছেন আর সিগারেট খাচ্ছেন। ঝুম বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে কাউকে সিগারেট খেতে প্রথম দেখছি। দূর থেকে আগুনের শিখা বেশী লাল মনে হচ্ছে। আমার পায়ের বুড়ো আঙুলটা অনবরত নড়ছে।

আমার এমন রোগ

আমার এমন রোগ

আমার মধ্যে এক রোগ বাস করছে,

সবকিছু মনে রাখার রোগ, মানুষ মনে রাখার রোগ;

আমার চোখের দেড়শ ডিগ্রির সীমারেখার মধ্যে আমি আজ পর্যন্ত যতজন মানুষকে বেঁধে রেখেছি,

তাদের সবার সাথে ছায়ার মতো লেগে থাকা একেকটি মুহূর্ত মনে রাখার রোগ;

বেশ কয়েক বছর ধরেই এমন একটি রোগে ভুগছি আমি,

এর কোনো কেমো নেই, থেরাপী নেই, আয়ুর্বেদ নেই, নেই কোনো ভ্যাক্সিন কিংবা এন্টিডট;

নিজেই নিজেকে কনসাল্ট করছি, রোজ মধ্যদুপুরে স্মৃতিসংঘের চেম্বারে আমার সাথে আমার দেখা হচ্ছে;

একই প্রেসকিপশন, সেই হেক্সশলের গন্ধ;

ওই প্রেসকিপশনে একই দাগের ওপর কলম ঘোরাচ্ছি;

মনবিদ্যা বলছে, এই রোগের একটাই ঔষধ পাওয়া গেছে আজ পর্যন্ত;

মৃত্যু।

হে বন্ধু ইরফান

হে বন্ধু ইরফান

~তোমার মতোই একদিন অভিনয় করা বন্ধ করে দেবে এই পৃথিবী, ও বন্ধু;

শেক্সপিয়ারের এই রঙ্গমঞ্চটায় আর কাউকে মিথ্যে অভিনয় করতে হবে না,

যেমনটি তুমি করোনি কখনোই,

তোমার চোখের মতো চোখ কথা বলবে সবার,

তোমার কষ্ট ভরা আওয়াজ ধ্বনিত্ব হবে পৃথিবী নামক এই থিয়েটারের আপার ক্লাস থেকে লোয়ার ক্লাসে,

ফ্রন্ট ডোর থেকে এক্সিট পয়েন্টে,

হাত তালিতে গমগম করবে পুরো দুনিয়া,

কারণ, তুমিতো সংলাপে একটাও মিথ্যে কথা বলোনি;

তুমি যেমনটা বলেছো, “সমুদ্রটাও আমি, এই গাছটাও আমি, ঝেলুম নদীটাও আমি, এসপেন গাছটাও আমি, আমি মন্দির, আমি সিয়া, আমি সুন্নী, আমি পন্ডিত, আমি সেখানে ছিলাম, এখানে আছি, আগামীকালেও থাকবো।”

শেষ বেলটা বেজে গেলো, হে বন্ধু;

আবারো তোমার নতুন চরিত্রের সংলাপ কানে বিঁধবে ইস্পলিন্টারের মতো, আবারো হাততালিতে গমগম;

তবে তোমার বুক চাপা কষ্ট নিয়ে দেয়া হাসিটা আর কেউ হাসতে পারবেনা,

আক্ষেপটা চলে যাক, তোমার সাথেই তোমার মতোই;

রুপ বদলাক, অবতীর্ণ হোক নতুন এক চরিত্রে;

যেমনটা তুমি হলে আজ, এতো নিঁখুতভাবে আগের মতোই।

হে প্রিয় বন্ধু ইরফান।~

বাম দিকের সিঁথি

বাম দিকের সিঁথি

কপাল বেয়ে চুয়েছিলো ভালোবাসার ঘাম,

আমি খুঁজে গিয়েছিলাম ফাঁকা এক গলি,

অষ্টেপৃষ্ঠে লেগে থাকা বুকের অভিমান,

ভুলতে বসা বিশ টাকার ওই দিনগুলি,

উদ্দেশ্যহীন রাস্তা-ঘাটে গিটারের সন্ধান,

ভাঙা তারে সুরের বড্ড বোঝ,

ডান দিকের ওই চুলের ভাঁজটা ঠিকই তো ছিলো,

এখন বাম দিকটায় কেনো করছো সিঁথি রোজ?

কতটা রঙ লাগবে তোমার; আমি রঙিন করতে চাই,

ভেজা ভেজা সন্ধ্যা বেলাকে,

লুকিয়েছে আজ কোনো কবিতায়!,

এক গোপন আংটি আঙুলের ফাঁকে,

হাওয়া বদলে গেছে নাকি আমি বদলেছি?

এই বদলানোটাই রেখেছিলো খোঁজ,

ডান দিকের ওই চুলের ভাঁজটা ঠিকই তো ছিলো,

এখন বাম দিকটায় কেনো করছো সিঁথি রোজ।

Pin It on Pinterest