শেষ জাদুর কাঁঠিটা প্রায় শেষের পর্যায়ে। জাদুর কাঁঠি মানে সিগারেট। লগারিদমের খাতাটা পেন চাপা দিয়ে বন্ধ করে সিগারেটের নাম সিগারেট কেনো,সেটা নিয়ে ভাবনা শুরু। পড়ালেখার জিনিস ছোটবেলায় উল্টিয়ে রাখতাম না। কেউ বলেছিল, “উন্টায়া না রাখিলে,শয়তান পড়িয়া ফেলায়।” তখন থেকে উল্টে রাখি। অভ্যাস হয়ে গেছে।
সিগারেটের মানে ভাঙতে লাগলাম। সিগারেটের সি = 011 গা = 101……আমি Math এর টিচার ওরফে ভাইয়া। ভাঙা-ভাঙি টা বাইনারিতেই করি। জীবনে একটা প্রেম করেছি। বাইনারি এক্সাম এর আগের রাতে ওই relation ভেঙে গেছে। সেই নিয়ে দু:খ নেই। যাই হোক,মুখে সিগারেট তখন থেকেই আমন্ত্রণ পত্র পেয়েছে। ছ্যাঁক খাওয়ার জন্য সিগারেট খাওয়া না,ইহা উদযাপন করার জন্য খাওয়া।
হঠাত চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেলো। আমি থাকি আট তালাতে। নিচে বাচ্চাদের চিল্লাচিল্লি শুনতে পেলাম। নিচের বাচ্চা কলোনিটা অনেক মজার। সেদিন এক সপ্তাহের বাজার একবারে করে এনে গেইট এ ঢুকছি। এক বাচ্চা বলে,”আজকে রাতে কি party হবে?” আমি একটু চমকে উঠলাম। তারপর একটা হাসি দিয়ে বাসায় ফিরলাম। এখন কার দিনের বাচ্চাদের এতোগুলা জিনিস মানেই party. এতোগুলা প্রেম = party,এতোগুলা ব্রেকআপ = party,এতো গুলা সিগারেট = party.
উফফ!সিগারেটের ছ্যাঁক হাতে লাগলো। তন্দ্রা ভাঙলো। বাচ্চাদের চেঁচামিচি এখন বন্ধ। তবে,মাঝেমাঝে কিছু বাচ্চা হাঁক দিয়ে উঠছে। আমি পেছন ঘুড়ে তাকালাম। বাইরে জোছনা নেই। অন্য ফ্ল্যাটের আলোগুলো ভেতরে আসছে। তবে,খুব ই অল্প পরিমাণ এ। একটা চুপচাপ ভাব কাজ করছে। যেনো ঝড় এসে,চলে গেছে। অথবা আসবে। বুঝে উঠলাম,কারেন্ট নাই।
আমার কাছে মোমবাতি নাই। কখনো প্রয়োজন পরেনি রাখার। সিগারেট টা শেষ হয়েছে। হাত দিয়ে মোবাইলটা খুঁজতে লাগলাম। অন্ধকারে খুব অসহ্য লাগছে। এর পরের দিন থেকে,চোখ বন্ধ করে হাঁটার practice করবো। কাজে দিবে। গরমে গা পুড়ে যাচ্ছে। উপলব্ধি করা শুরু করলাম,সারাদিন গা পুড়িয়ে যেসব অন্ধ মানুষ জ্যাম হলে আমি বসে থাকা CNG টাতে ছুঁটে আসে টাকার জন্য তাদের অনুভূতি কেমন হয়। না,ব্যাপার টা কর্কশ। ভাবা অহেতুক। ঘামছি। পরিমানটা একটু বেশী। চোখটাও জ্বলছে। দুইদিন আমি নির্ঘুম আছি। নতুন একটা experiment করছি। হ্যালোশিনেসন করার try করছি। তিন দিন টানা না ঘুমালে হ্যালোশিনেসন হয়। আমার বিশ্বাস,আমার ক্ষেত্রে ইহা দুইদিনেই সম্ভব। হ্যালোশিনেসন হলে কাছের মানুষদের দেখা যায়। আমিও কাউকে দেখতে চাই।
মোবাইলটা পেলাম। Flash Light টা জ্বালালাম। আলোটা অল্প। তবে আনন্দদায়ক। কখনো আলোর কাছ থেকে আনন্দ পাইনি। এখন পাচ্ছি। ভালো লাগছে। বড় আপার বাবু হবে। জমজ বাবু। আপাকে বলতে হবে,একটার নাম আলো আর একটার নাম আনন্দ রাখো। আগে পিছে নিজের মতো লাগিয়ে নাও। তোমাদের সন্তান। মামার কাজটুকু আমি করলাম,ওদের ডাক নাম দিলাম। মামারা ডাক নাম দেয়। আমার পলাশ নামটা বড় মামার রাখা। উনার চেহারা নূরানি চেহারা। এই অন্ধকার ঘরে উনি থাকলে কোনো বিদ্যুৎ লাগতো না। তবে বাতাসের অভাব কিভাবে মেটাতাম সেটা ভাবা লাগবে। আমার ফ্ল্যাটটা ছোট। একা থাকি,বড় বাসার প্রয়োজন নেই। ঘর থেকে পা বাড়ালেই dining room. বাসায় নূপুর পড়ে হাঁটাহাঁটির কেউ নেই। এমন কেউ থাকলে হয়ত শোবার ঘর থেকে খানিকটা দূরে অন্য রুমগুলোর ব্যবস্থা করা লাগতো। সে পায়ে নূপুর লাগিয়ে ঝনঝন করে হেঁটে যেতো অন্য রুমে,আওয়াজটা শুনতে ভালো লাগতো। Dining room এ ফ্রিজের উপর একটা charger আছে। পেয়ে গেলাম এবংজ্বালালাম।
আলো টা খুব অল্প। একে এর ন্যায্য অধিকার দেয়া হয়নি। অনেক দিন charge এ দেয়া হয়নি। মানুষ হলে,খাওয়ার জন্য হুড়োহুড়ি লাগিয়ে দিতো। এটি জড় বস্তু। জড় বস্তু শান্ত থাকে। কথা না বললে,কেউ দাম দেয় না। তবে,Anderson Hypes এর মতবাদ আমাকে নাড়া দিয়েছে,”জড় বস্তু শান্ত সময় শান্ত থাকলেও পরিবেশ অশান্ত থাকলে,ইহাও অশান্ত হয়ে যায়।” ঘটনা সত্যি। আমি charger টা জ্বালিয়ে ঘরে আসলাম। বারান্দার দরজাটা দিয়ে বাতাস ঢুকছে। হিমালয়ের গা লেগে আসা বাতাস বুঝায় যায়। বেশ ঠান্ডা। বৃষ্টি হতে পারে। তবে,আজকের বৃষ্টিতে আমার কিছু যায়-আসে না। আমরা মানুষ। যাওয়া-আসার হিসেব আগে করি। যেহেতু মানুষের জীবনটা যাওয়া-আসার মধ্যে আটকিয়ে থাকে,তাই এইটা নিয়েই হিসেব করা উচিত। আমরা সেটা ভালো বুঝি। এই কারণেই হয়ত আমরা আশরাফুল মাখলুকা। তবে,এই নিয়ে আমার গর্ব করা সাজে না। নামায ঠিকমতো পড়া হয়না। ‘সৃষ্টির সেরা জীব’ শব্দটার থেকে ‘সেরা বান্দা’ শব্দটা বেশী কানে বাজে। বাতাস আমার ঘরের পর্দা টা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। পরীক্ষা খারাপ হলে জীবনটা যেমন এলোমেলো মনে হতো,সেই রকম। পর্দা জড় বস্তু। পরিবেশ অশান্ত হলে,পর্দাও অশান্ত হবে এইটাই স্বাভাবিক। অনেকক্ষণ ধরে পর্দার ওপাশে কিছু ছায়া আমি উপলদ্ধি করছি। মাথায় নি নাই। Charger টা ফ্রিজের উপর জ্বালিয়ে রেখে এসেছি। উইপোকা তার মাথার উপর ঘোরাঘুরি করতে পারে। আর বিজ্ঞান যদি ভুল না করে থাকে,তবে তার ছায়া floor এ পরতেই পারে। অন্ধকারের কারণে ছায়াটা বড় মনে হচ্ছে। Charger টার সামনে এখন একটা লবণ দানা ধরলেও তা বাক্সের সমান লাগবে। এইটা অস্বাভাবিক কিছু না।
হঠাত পর্দা দুইটা সরে গেলো। না,সরিয়ে দেয়া হলো। আমার বড় মামা ঘর এ প্রবেশ করলেন। আমি বিচলিত নয়। দুটি কারণ,প্রথমত উনি আমার পরিচিত মুখ। কোনো মৃত পরিচিত মুখ দেখে ভয় পাওয়ার কিছুই নাই। দ্বিতীয়ত,উনার চেহারা নূরানি চেহারা। ঘরে আলো ফিরে এসেছে। তাই একটু শান্তি লাগছে। শান্তিতে থাকলে মানুষ বিচলিত হয় না। তবে,কিছুটা গরম লাগছে। এমতাবস্থায় বাতাসের ব্যবস্থা কিভাবে করা যায় তা নিয়ে পরে ভাবতে হবে। মামা খাটে বসলেন। আমি পেছন ঘুরলাম। মামার চোখ জ্বলজ্বল করছে। হরিণের চোখের মতো। একটা লেখা মনে পড়ছে,’জ্বলন্ত হরিণ চোখ,ভিত হয় ভীতু লোক।’ মামার আওয়াজ মোয়াজ্জিনের মতো। কিছুটা চিকন,পুরোটা মধুর।মামা বললেন, “তোর অবনতি চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে এসেছি।” “মামা আপনি যে সত্যি সত্যি আসেননি,সেইটা আমি জানি।” “কি বলতে চাস?” “কিছু বলতে চাই না। আল্লাহ মাফ করুক। প্রথম কথা সালাম দিয়ে হওয়া উচিত ছিলো। আসসালামুয়ালাইকুম।” “ওয়ালাইকুমাসসালাম। সালামের মানে জানা আছে?” “জ্বি। আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক।” “হুম। সিগারেট টা কবে ছাড়বি তুই?” “আপনি বললেই ছেড়ে দেবো।” “আমি বললাম,ছেড়ে দে।” “জ্বি,কালকে একটা দামী সিগারেট খেয়েই ছেড়ে দেবো। শেষ সিগারেট টা কম দামী হলে অপমানিত বোধ হবে।” “কথা দিতে বলবো না তোকে। তোকে আমি চিনি। তুই ছাড়বি জানি। বাসায় পানি আছে?” “মামা,আপনি কি অজু করবেন?” “না,খাবো।” “আপনাকে পানি দিয়ে লাভ নেই। আপনি আসল না। আপনি আমার হ্যালোশিনেসন। মৃত্য ব্যক্তি দেখতে পাওয়া হ্যালোশিনেসন এর প্রথম পর্যায়। ‘হ্যালোশিনেটেড অবজেক্ট কোনো কিছু খেতে না পান করতে পারে না।’ John Abram এর বই। পৃষ্ঠা 15.”
“তুই একটু বেশী বুঝিস। সেই কারণেই মাস্টার হয়েছিস। তোর বাপও বেশী বুঝতো। বেশী বোঝা মানুষ মাস্টার হয়।” “রাগ করবেন না,মামা। আপনি রাগলে আপনার মুখ লাল হয়ে যায়। লাল হওয়া মুখ দিয়ে আরো বেশী আলো বের হয়। বেশী আলো ভালো না। চোখের রেটিনা ভেদ করে মার্গুলাস মাশল এ attack করে। ইহা চোখের চশমা লাগানোর একটি কারণ।” “তুই আবার পটরপটর করছিস?” “হ্যালুশিনেটেড অবজেক্ট কে বিরক্তির মধ্যে রাখা উচিত।” “তুই কি চাস,আমি চলে যাই?” “না। আমি চাই কারেন্ট আসুক। গরম ভালো লাগছে না।” “তোকে কিছু কথা বলার জন্য এসেছিলাম। এক কাপ চা দে,খেতে খেতে কথা বলি।” “মামা,আপনি কিছু খেতে পারবেন না। খেতে যাবেন,ওমনি vanish হয়ে যাবেন। আপনাকে দেখতে ভালো লাগছে। Vanish হওয়ার প্রয়োজন নেই। কথা বলুন। আমি শুনি।” “তুই গ্রামে কতদিন ধরে যাস নি?” “৮ মাস।” “কেনো যাসনি?” “আপনি আমার কাছের ছিলেন। আপনি মারা যাওয়ার পর,আর যাওয়ার interest পাইনি।” “তোর মা রোজ কাঁদে।” “জানি। মাকে কষ্ট দেয়া উচিত নয়। তবে,ছুটি পাইনা। পেলেও অন্য কাজে জড়িয়ে পড়ি। টাকা রোজগার এখন না করে আবেগাপ্লুত হলে চলবে না। আবেগ কখনো খেতে দেয়না। লেখকরা আবেগ বেঁচে খাওয়া-দাওয়া করে। আমিও লেখক। তবে,white board এ লিখি। আমার জীবন লগারিদম আর বাইনারির মাঝখানে পড়ে থাকা কোনো এক সিগারেটের ঝলসানো তামাক পাতার মধ্যে আঁটকিয়ে আছে। আবেগ দিয়ে আমার কাজ নেই। ভালো অবস্থায় যাই,মাকে নিয়ে আসবো।”
“শুনে ভালো লাগলো। তোর বোন আলেয়ার জমজ বাচ্চা হবে। ওরা ওদের নাম আলন্দ আর আলো রাখবে বলে ঠিক করেছে। কিছু জানিস? নাম দুইটা আমার পছন্দ হয়নি। আলো-বাতাস,আল্লাহর তৈরী। ওইসব জিনিস কোথায় কিভাবে লাগাতে হবে,আল্লাহ ভালো জানেন। মানুষের উচিত আল্লাহ নামে নাম রাখা। কি বলিস?”
“পরশু দিন কথা হয়েছে। তবে,নামের ব্যাপারটা জানি না।”
“পারুল বিয়ে করতে চাইছে না। আমি মারা যাওয়ার পর,ওর মায়ের কথা শুনে না। তুই বুঝা।”
“পাত্র কি ঠিক?”
“না,এই কাজটা তোর। তুই ওর ভাই। মামাতো ভাই ও আপন ভাই হয়।”
“জ্বি,আমি কথা বলবো। মামা,বেয়াদবি মাফ করবেন। আপনার পাঞ্জাবিটা নোংরা মনে হচ্ছে। আমি কি ধুয়ে দেবো?”
“তুই কি আমাকে সত্যি ভয় পাচ্ছিস না?”
“না,মামা। পেলে কথা বলতাম না। শুধু চিতকার করতাম। ভয়ে মানুষ দুটো জিনিস করে। হয়তো,বোবা হয়ে যায় নাহলে চিতকার শুরু করে।”
“আবারো পটরপটর করছিস। পানি দে তো।”
“মামা,আপনি কি যেতে চান?”
“হ্যাঁ,এখন যাওয়া উচিত। তোকে একটা কথা বলি। ভাববি কম,করবি বেশী।”
“জ্বি,আচ্ছা।” আমার চোখ খুব জ্বলছে। চোখ চুলকালাম। মামা নেই। অনেক বাতাস গায়ে লাগছে। হিমালয়ের গা ঘেষে আসা বাতাস না। কৃত্রিম পবন। কারেন্ট এসেছে। আমি মনে মনে অনেক খুশি। ‘সিগারেট’ শব্দটার মানে বের করেছি। সিগারেট প্রথম মায়ান সভ্যতায় দেখা দিয়েছিলো। মায়ান অভিধানে সিগারেট মানে ‘নিমিষে নি:শেষ।’ এর ছোট size এর জন্য এমন নামকরণ। তবে,এর টানে আমাদের জীবন নিমিষে শেষ হয়ে যাওয়ার পথে এক ধাপ এগুচ্ছে,এইটাও ঠিক। পকেটে বেশী টাকা নেই। কালকে দামীটা খাওয়া যাবেনা। অনেক মানুষের আমাকে দরকার। অকালপক্ক আর অকাল মৃত্যু ভয়ানক ব্যাপার। যার হয়,সে আশেপাশের সাবাইকে বিপদে ফেলে দেয়।
আমি উঠে dining room এ গেলাম। এক গ্লাস পানি মেঝেতে পড়ে আছে। কাঁদার ছাপ,পায়ের আকৃতির। মামার পা,বোঝা যায়। বেশ ভরাট। হ্যালোশিনেসন মাঝেমাঝে অনেক বেশী সত্যি মনে হয়। কলিংবেল টা বেজে উঠলো। আসগর সাহেব পাশের বাসা। উনি মুখ ভেতরে ঢুকিয়ে কি যেনো দেখলেন। তারপর বললেন, “আপনার বাসায় কারেন্ট আছে,আমাদের বাসায় নেই কেনো।”
“Cut out এর প্রব্লেম হবে হয়ত।”
“জ্বি,না। আমাদের বাসায় নেই মানে,পুরো এলাকা তেই নেই। আপনি কি IPS চালান?”
“জ্বি,না। পাওয়ার গ্রিডে সমস্যা হতে পারে। আমার খুব কাছের বন্ধু সাভার পাওয়ার গ্রীডে কাজ করে। BCS পরীক্ষায় আমার দেখে পাশ করেছে। ও আমার কাছে চিরকৃতজ্ঞ। আমার পা ধুয়ে বোতলে করে পানি নিয়ে যেতে চায়। বলে,হাফ গ্লাস ও খাবে আর হাফ গ্লাস ফ্রিজে রাখবে। ওর কাজ হয়ত এইসব। আমি যেনো কষ্ট না পাই,তাই আমার বাসায় রেখে বাকিগুলা টেনে নিয়েছে।” লোকটা বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে। মানুষকে বিস্মিত করতে ভালো লাগে। গায়ের ক্লান্তি ঝরে যায়। উনি হয়তো বিলাপ বকছেন। আমি শুনিতে পারছি না। দরজা লাগিয়ে ভেতরে আসলাম। বিছানার চাদরটা ভাঁজ ভাঁজ হয়ে আছে। ঠিক না করে,গা টা এলিয়ে দিলাম। আজকে একটু ঘুমানো উচিত।
“আপনি কি ভূত ভালোবাসেন?” আমি লোকটার দিকে তাকালাম। কালো রঙের প্যান্ট পরা,সাদা চেকচেক শার্ট। শার্ট প্যান্টের ভেতর গুঁজে রাখার জন্য তৈরী হয়েছে। উনি গুঁজে রাখেন নাই। গা থেকে কড়া এক সিগারেটের গন্ধ বের হচ্ছে। তবে,গন্ধটা ভালো লাগছে। উনি শ্যামলা, কিন্তু মুখে সাবান মেখে যত্ন কম নেন হয়ত। মনে মনে ভাবতে লাগলাম,ভূতও কি ভালোবাসার জিনিস? প্লাটফর্ম এর মর্চে ধরা লাল বেঞ্চিটাতে আমার সাথেই বসা। সিলেট যাওয়ার জন্য ট্রেন এর অপেক্ষায় দেড় ঘন্টা ধরে এইখানেই বসে আছি। ইনাকে তো দেখি নি। উনি হাঁক দিয়ে উঠলেন। “জ্বি,আপনাকেই বলছি। সিগারেট খান?” বিস্ময় নিয়ে জবাব দিলাম “একটু-আধটু।” উনি একটা সিগারেট দিলেন। আমি নিচ্ছিনা। উনি আমার জবাবের অপেক্ষায় আছেন। আমি জবাব দিলাম, “আমি দুপুরে খাওয়ার পর একটা খাই আর রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে একটা খাই। এর মাঝে খাই না।” উনি কিছুটা অবাক হলেন। মানুষকে অবাক করা জবাব দিতে ভালো লাগে। সিলেটে ফুপা মারা যাওয়ার খবরে মনটা খারাপ ছিলো এখন ভালো লাগছে। উনি বলে উঠলেন, “আপনি সিগারেট খান,নাকি ঔষধ খান? অভ্যাস পাল্টান। ভদ্রতার খাতিরে হলেও অভ্যাস শিথিল করা উচিত।” আমি হাতের পেপারটা গোল করে ভাঁজ করতে লাগলাম। উনি আবার বললেন, “আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম। ভূত ভালোবাসেন?”
“ভূত কি ভালোবাসার জিনিস?”
“দেখুন মানুষের ভালো লাগা অনেক ধরনের। আমার এক বন্ধু আছে। ওর প্রিয় জিনিস মরা মানুষ। লাশ বেচাকেনার ব্যবসা করে। দুইবার ধরাও খাইসে। ওরে পুলিশ পিটিয়ে লাশ বানাইতে পারে নাই। লাশ দেখে দেখে নিজে শক্ত হয়ে গেছে। অদ্ভুত কিসিম এর মানুষ। কিসিম আর কিসমিস,দুটোই আমার খুব প্রিয়।” উনি এক নাগাড়ে বলে গেলেন,আমিও এক নাগাড়ে শুনে গেলাম।
“আপনার কেনো মনে হলো আমি ভূত পাগল মানুষ?”
“হতেই পারেন। ভালোবাসা মানে লুতুপুতু ভালোবাসা না। ভয় পাওয়ার মধ্যেও ভালোবাসা থাকে। মানুষ ভূত ভয় পায়। কেউ যদি বলে সে ভূতে ভয় পায়না,আমি এই সিগারেটের প্যাকেটের কসম খেয়ে বলতে পারি তার সামনে ভূতের কাহিনী বললে সে ভয় পাওয়ার স্বরূপ তার পায়ের বুড়ো আঙুলটা একটু হলেও নাড়াবে। আমার একটা উক্তি আছে,ভূতে ভয় করে যেইজন সেইজন সেবিছে ভূতপ্রেমিক।”
“প্যাকেটের কসম খেলেন। ঘটনা যদি মিথ্যা হয়?”
“মিথ্যা হলে এই রাতে একটু পর বৃষ্টি নামবে,আমি ভিজে যাবো। তার সাথে আমার সিগারেটের প্যাকেট টাও বিড়াল-কুকুরের মতো ভিজবে।”
উনি হয়ত “It is raining cats and dogs” বাক্যটা কোথাও শুনেছেন। বাক্যের সাথে মানের মিল না খুঁজে পাওয়ায় উনি বিস্মিত। তাই নিজের মতো করে বিড়াল-কুকুর বলে চালিয়ে দিলেন। আবারো উনার আওয়াজ শুনলাম, “সিলেটের ট্রেন তো লেইট? আমি মোতালেব। বালুর ব্যবসা করি। ব্যবসা করি আর জোঁকের কামড় খায়। হে হে।” উনার হাসিটা অদ্ভুত রকমের খারাপ। বালুর ব্যবসার সাথে জোঁকের কামড় কিছুটা মিলাতে পারেছি। আমি বললাম, “আমিতো আপনাকে বলি নাই আমি সিলেট যাবো।”
“এই স্টেশনে রাতের শেষ ট্রেন সিলেট এর। আপনাকে বেঞ্চে শুয়ে থাকা মানুষ এর মতো মনে হয় না। তারমানে আপনি যাত্রা করবেন। আর,যাত্রা করলে সিলেট এই যাবেন।” মেঘ ডাকছে। আমি মনে মনে ভাবছি বৃষ্টি আসলে,ভালো হবে। তাড়াহুড়ো করতে যেয়ে গোসলটা করা হয়নি। বৃষ্টি পরিবেশ ঠান্ডা করে। সারাদিন গোসল না করা মানুষ সেই ঠান্ডা পরিবেশ উপভোগ করে। যদিও মাথা ব্যথা শুরু হয়। তার পরেও উপভোগ যোগ্য। উনি আবার সাড়া দিলেন, “বৃষ্টি আসবে না। আমি বাজি ধরতে পারি।”
“যদি আসে?”
“আসলে আপনাকে একটা কেরামতি দেখাবো। বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে ভেজা ম্যাচ দিয়ে একটা ভেজা সিগারেট জালিয়ে খাবো। দুই টানে শেষ করবো। দুইটানে সিগারেট শেষ করলে,মাথা চিনচিন করে। এমন অনুভূতি আছে?”
“আমি তৃপ্তি নিয়ে সিগারেট খাই। এমন অনুভূতি নেই।”
“আজকে তাহলে দেখবেন কেরামতি। বৃষ্টি আসলেই দেখতে পাবেন।” বৃষ্টি নয়,ট্রেন আসছে। আমি উঠে দাঁড়ালাম। ব্যাগটা নিলাম। উনিও উঠে দাঁড়ালেন। “আপনার সাথে কথা বলে ভালো লাগলো। যাত্রা শুভ হোক। ট্রেনে যাত্রার আগে কলা খাওয়া উচিত। যাত্রা শুভ আর অতি দ্রুত হয়। একটাও দোকান খোলা নাই,নাহলে কলা খেতে বলতাম।”
আমি জবাব দিলাম, “জ্বি,ধন্যবাদ।” ট্রেনের আলো স্টেশনের পিলার গুলোতে বাড়ি খাচ্ছে। ট্রেনটা প্রায় চলে এসেছে। এইসময় হঠাত বৃষ্টি শুরু। আমি পাশে তাকালাম। দেখলাম লোকটা নাই। ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আমি প্রায় ভিজে যাচ্ছি। নিচে তাকিয়ে দেখি সিগারেটের প্যাকেট আর ম্যাচের বাক্স পড়ে আছে। সেগুলো অসহায়ের মতো ভিজছে। বৃষ্টিতে বিড়াল-কুকুর ভিজলে যেমনটা লাগে,সেরকম লাগছে। আমি ছুটে ট্রেনে উঠলাম। আর ভেজা যাবে না। সিটটা খুঁজে বসে পড়লাম। রুমালটা খুঁজে পেলাম না। ট্রেন চলা শুরু করলো। জানালা দিয়ে চোখটা বাইরে গেলো। মোতালেব সাহেব মেঝেতে বসা। তিনিও ভিজছেন। হাতে একটা সিগারেট। তিনি ভিজছেন আর সিগারেট খাচ্ছেন। ঝুম বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে কাউকে সিগারেট খেতে প্রথম দেখছি। দূর থেকে আগুনের শিখা বেশী লাল মনে হচ্ছে। আমার পায়ের বুড়ো আঙুলটা অনবরত নড়ছে।
Rajiul Huda Dipto is a professional screenplay writer and working for years in the Bangladeshi TV industry. Besides that, he introduces himself as a photographer, whose photographs have been featured in various magazines and exhibitions all around the world. Not regularly, but he publishes his works in national dailies as well. Currently, he is working as a community writer in BuzzFeed and a contributor in Getty Images.
“দিনের বেলা রোদের মধ্যে বৃষ্টি হচ্ছে। তুমি তোমার কাজিন আর মামা-মামির সাথে এই হোয়াইট প্যালেসের ছাদে বৃষ্টিতে ভিজছো। এইটা তোমার দাদা বাড়ী। পাশেই দেয়াল ঘেষে লাগানো তোমার বাবার বাসা। হোয়াইট প্যালেসের তুলনায় ছোট। বৃষ্টির মধ্যে, নায়ক তার ছোট ভাই আর কাজিন নিয়ে তোমার বাড়ির সামনের মাঠটা পেড়িয়ে যে চায়ের স্টল আছে সেখানে এসেছে। প্রতি সপ্তাহের সোমবার এই ছোট জায়গায় হাট বসে রাতের বেলা। গত সোমবার রাতে সে একবার এসেছিলো এইখানে। ফ্ল্যাশব্যাকে সেই সিনটা যাবে। নায়কের গায়ে চাদর। কোনো ভারিক্কি চাদর নয়, বরং একটা ইয়ং ছেলের যেমন ছোট আর পাতলা চাদর পড়া উচিত তেমন একটা চাদর থাকবে তার গায়ে। দিনের মধ্যে, রোদের মধ্যে যেহেতু বৃষ্টি সেহুতু চারিদিক চমকাচ্ছে। গাছের পাতাগুলো ক্যামেরায় আলাদা ইফেক্ট আনছে। নায়ক একবার চাদর ঠিক করে, তোমাদের হোয়াইট প্যালেসটার দিকে তাকিয়ে চায়ের দোকানে ঢুকতে যাবে কিন্তু সে ঢুকবে না। তখনই, সে তোমাদের ছাদে আবিষ্কার করবে। তার কাজিন আর ছোট ভাই দোকানে ঢোকার পর চায়ের অর্ডার দিয়ে বসেছে। বৃষ্টির বেগ বাড়বে না, একই রকম থাকবে। তোমাকে ভিজেই যেতে হবে। এই ভেজা, অশালীন লাল শাড়ি পড়ে ভেজা নয়। তোমার অঙ্গভঙ্গিও মার্জিত হবে। তোমার সামনে তোমার ছোট কাজিনরা আর মামা-মামী আছেন। নায়ক চায়বে, তোমাদের সামনে না আসতে। তোমার পরিবার নায়ককে চেনে এবং অন্য সম্পর্কের কারণে আদর করে। সুতরাং, দেখলেই তাকে বাসায় ডাকবে। আর, সে তোমার সামনে যেতে চায়না। কি কারণে, যেতে চায়না সেটা নিশ্চয়ই স্ক্রিপ্ট পড়ে জেনে গিয়েছো। এখন, সে লুকিয়ে ছাদের দিকে তাকানো। হুট করে, তোমার মামা-মামী দেখে ফেলে তাকে উপরে ডাকে। একই সাথে তোমার কাজিনরা এলং উইথ তুমি, তাকে হাত নেড়ে ডাকতে থাকো। মনে রেখো, ক্যামেরা ছাদের উপর থাকবেনা নিচে থাকবে। তাই, নায়কের কাজ কম আর তোমার বেশী। দূর থেকে প্রেজেন্স বোঝাতে হবে তোমাকে। নায়ক ইতোমধ্যে বিচলিত হয়ে গিয়েছে। সে ডাকে সাড়া দিতে চায়না। তুমি পৌশাচিক আনন্দ পাচ্ছো সবাই তাকে ডাকছে দেখে। কারণ, সে তোমার সাথে দেখা করতে না চায়লেও তুমি তার সাথে দেখা করতে চাও। তার সাথে এতো বছর পরে দেখা হওয়ার পর, তুমি্ স্বদিচ্ছায় এমন কষ্টটা উপভোগ করতে চাও”।
পরিচালক তার বর্ণনা শেষে এইবার থামেন। উনার সামনে বসে আছেন বাংলার এই সময়ের চাহিদসম্পন্ন নায়িকা শর্মিলা। উনার চেহারা রুরাল ক্যারেক্টারের জন্য আদর্শ। টানা চোখ ইদানিংকালে প্রায় সমস্ত নায়িকার থাকে, উনার আছে ভরাট গাল যা অন্য নায়িকাদের খুব একটা নেই। চুল ছাড়লে যেমন কিশোরী লাগে, অমনি চশমা পড়লে গ্রামের প্রাইমারী স্কুল টিচারের মতো লাগে। উত্তম বাবুর সাথে ‘নায়ক’ সিনেমায় যেমনটা লেগেছে। সেই ছবির পরিচালক, আর এই ছবির পরিচালক একজনই। উনার নাম লিখতে গিয়েও হাত কাঁপে। সত্যজিৎ রায়। ডাক নাম ‘মানিক’। প্রথমে তাঁর নাম রাখা হয়, ‘প্রসাদ’। এই কথা প্রচলিত আছে যে, রবীন্দ্রনাথকে উনার নাম রাখতে বলা হলে উনি তাঁর নাম রাখেন ‘সহজ কুমার। কারণ, সত্যজিৎ রায়ের কাকাতো ভাইয়ের নাম ছিলো ‘সরল কুমার’। রবি ঠাকুর ঠাট্টা করেই এমন নাম রাখেন। পরবর্তীতে, সুকুমার রায় তাঁর নাম পাল্টে রাখেন সত্যজিৎ রায়। এই প্রথম উনাকে আমি এতো সামনে থেকে দেখছি। উনার চেহারা প্রচন্ড পরিমাণে রাগী আর আওয়াজ উনার শক্ত হাতটার মতই ভারী। উনি নায়িকাকে দৃশ্য বোঝানো শেষ করলেন। আনন্দ পত্রিকার চিফ এডিটর আমার সদ্য পাওয়া ডেস্কে ফাইল পাঠিয়ে বললেন, “যা, জিলে আপনি জিন্দেগি”। আমি সাথে সাথে উনার রুমে গিয়ে বললাম, “এইটা ‘উপভোগ’নাকি ‘উপযোগ’? আমার চাকরীটা কি খাবেন? আমি সত্যজিৎ রায়ের ইন্টারভিউ নিতে পারবোনা”। চিফ এডিটর সদামোহন বললেন, “শ্যুটিং শেষ আর পরের ছবির স্ক্রিপ্ট লেখার মাঝখানের যেসময়টা আছে উনি আমাদের সেই সময়টা দিবেন আজ। উনার ইন্টারভিউ মানে, আমাদের লাভ, তোমার খ্যাতি আর বেতন বাড়ার চান্স”। আমি কিছু না বলে বেরিয়ে আসবো, সদামোহন তখন বলে উঠলেন, “উনার সাথে দেখা করে ফেরার সময় রায়ের বাড়ির চায়ের অফার দিবেন উনি। ভুলেও যদি মিস করো, তাহলে বাসায় এসে বিষ খেও”। কোনো উপায় না দেখে আমি এক ঘন্টার মধ্যে কিছু প্রশ্ন সাজিয়ে সোজা শ্যুটিং সেটে চলে আসলাম।
সিন শুনে শর্মিলা বললেন, “মানিকদা, আমার ডায়ালগ কি এই সিনে?” সত্যজিৎ বললেন, “এক্সপ্রেশন ইজ ইওর ডায়ালগ।” শর্মীলা এইবার হেসে বললেন, “তাহলে আমাকে এতো বর্ণনা দিলেন কেনো?” বৃষ্টির বেগ, নায়কের চাদর, চায়ের দোকান, বাড়ির বর্ণনা, এইসব শুনে আমি কি করবো?” উনি বললেন, “একটি দৃশ্য যদি দৃশ্য না শুনে, তাহলে সেই দৃশ্য দৃশ্যমান হবে কি করে? এই দৃশ্যের তুমিই দৃশ্য।“ এই বলে, সত্যজিৎ রায় উঠে গেলেন। আমি উনার ঠিক পেছনের দিকে খাতা কলম রেডী করে বসা। যা বলছেন, তাই টুকছি। ইতোমধ্যে আমি আমার নিউজের হেডলাইন পেয়ে গেছি হয়তোবা। সেটি হচ্ছে, “এই দৃশ্যের তুমিই দৃশ্য”। লিখে রাখলাম। উনি উঠে রুম থেকে বের হবেন, এমন সময় উনার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন ক্যামেরাম্যান রবিলাল স্যান্নাল। উনার থেকে ম্যানেজ করে, সময় বের করা হয়েছে। বলা যেতে পারে, উনাকেই আমি এইখানে চিনি। চিনি থেকে মনে পড়লো, কম চিনির এক কাপ চা সেটে আসার পরেই আমাকে দেয়া হয়েছিল। সত্যজিৎ রায়ের সেটে নাকি, কম চিনির চায়ের বেশ প্রচলন আছে। উনি মনে করেন, চিনি বেশী খেলে নাকি ঘুম বেশী আসে। সেটা চায়ে দিয়ে খাওয়া হোক, কিংবা বিষে।
সত্যজিৎ রায় উঠে দাঁড়াতেই রবিলাল বাবু উনাকে আমাকে দেখিয়ে কিছু একটা বললেন। উনি আমার দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে হাঁটা দিলেন। রবিলাল বাবু, আমাকে উনার সাথে ডাকলেন এবং সত্যজিৎ রায়ের পেছনে দেখলাম উনিও হাঁটা দিলেন। আমি কাগজপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে ছিলাম, হেড লাইনের জন্য নীল, কারেকশনের জন্য লাল আর লেখার জন্য কালো কালির পেন। পেন্সিল আছে, তবে কোনো কাজের নয়। সাথে করে নিয়ে এসেছিলাম, নাহলে সে একা একা আমার অফিসের ডেস্কে বসে থেকে পরচর্চা শিখতো। আমি উঠতেই সব কাগজপত্র মেঝেতে পড়ে গেলো। ভাগ্য প্রসন্ন, এতোক্ষণে শর্মিলা এই ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছেন। আমি সব কুড়িয়ে তাদের পেছনে হাঁটা দিলাম। বাইরে, বিশাল বড় সেট। এতোদিনে, সত্যজিৎ রায় বেশী টাকার সিনেমা বানাতে শুরু করেছেন। উনিই একজন ইন্ডাষ্ট্রি। আসলেও, তাই। সত্যজিৎ রায় রবিলাল বাবুকে সাথে নিয়ে, সেট নিয়ে আলোচনা করছেন। বাইরে, ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে তাই কৃত্রিম বৃষ্টির দরকার নেই এই সিনের জন্য। আমি উনাদের খুব কাছেই দাঁড়িয়ে আছি। উনি রবিলাল বাবুকে বললেন, “ইজ ইট পসিবল মাঠের ঠিক মিডিল থেকে এই ক্যামেরা এগিয়ে আসবে নায়কের দিকে দুই সেকেন্ড পার ফুট স্পিডে, যখন কিনা সে তাঁর গায়ের চাদরটা ঠিক করবে?” রবিলাল বাবু বললেন, আমাদের ট্রলি না এতো বড় আছে না এতো বড় চাকা আছে মানিক দা”। সত্যজিৎ একটু ভেবে বললেন, “বাজেটের বাইরে যাবে না? এক কাজ করো, উপর থেকে মানে নায়কের ঠিক উপর থেকে শট নিবে। ক্যামেরা নামছে নামছে আর নামলো আর নায়ক চাদর তাঁর গলাতে জড়ালো। মনে রাখবে, তাঁর পা আসা যাবেনা, শুধু কোমর”। রবিলাল বাবু বললেন, “ঠিক আছে। কিন্তু, আগের শটটা নিতে পারলে দারুণ হতো। সত্যজিৎ বললেন, “কি করবে? নেসেসিটি ইজ দ্যা প্রায়রিটি।“ আমি আরও একটি হেডলাইন পেয়ে গেলাম। “নেসেসিটি ইজ দ্যা প্রায়রিটি – সত্যজিৎ রায়”।
এবার দেখলাম, উনি একটু এগিয়ে গিয়ে এডিটিং রুমে গেলেন। শ্যুটিং সেটেই এডিটিং প্যানেল। সত্যজিৎ রায় শ্যুটিং শেষেই এডিটিং এ বসেন, আমার এইটা জানা ছিলো। কিন্তু, এই প্যানেল যে উনার সেটেই মুভি সেটে বসানো রাখবেন সেটা ভাবিনি। আমিও উনার পেছন পেছন ভেতরে ঢুকলাম। একটা অন্ধকার রুম। একটা স্ক্রিন। তখনও ডিজিটাল এডিটিং মেশিন টলিউডে আসেনি। বোম্বেতে এসেছে, কিন্তু সবাই এফোর্ড করতে পারেনা। তাই, ম্যানুয়াল। প্রিন্ট ধরে কাটতে হয়। আমি দরজার কাছে বেশী অন্ধকার জায়গা দেখে এক পাশে দাঁড়িয়ে গেলাম। সত্যজিৎ রায়, একটা চেয়ারে বসে কাটা শুরু করলেন। স্ক্রিনে দেখলাম, “চিড়িয়াখানা” মুভির দৃশ্য। শরবিন্দু বন্দোপাধ্যায় এর বোম্বকেশ বক্সী। উত্তম কুমার সিগার থেকে ধোঁয়া উড়াচ্ছেন। তাঁর বন্ধু আবছা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। একজন লোক আছে রুমে, উনি কেসটা নিয়ে এসেছেন। উত্তম কুমার, সিগারে একটা টান দিচ্ছেন আর লোকটা উনার দিকে তাকিয়ে কথা বলে যাচ্ছেন। উনি সিগার টানার পর ধোঁয়া ছাড়বেন ঠিক এই মূহুর্তে সত্যজিৎ রায় “কাট” বলে ফিতা ধরে কেটে দিলেন। ঠিক পরের সিনটা দিলেন, ধোয়াটা উত্তম কুমার লোকটার দিকে তাকিয়ে হাওয়াতে উড়িয়ে দিলেন। এন্ড অফ এ সিন। সত্যজিৎ রায়, এইবার সিগারেট ধরালেন একটা। পাশে বসে থাকা দুইজন লোকও সিগারেট ধরালেন। অন্ধকার রুমে, স্ক্রিন থেকে উড়ে আসা আলোতে দেখতে পেলাম সত্যজিৎ রায়ের সিগারেট থেকে বেরিয়ে আসা ধোঁয়া সবচেয়ে বেশী উপরে উড়ছে। আমার দৃষ্টিভ্রমও হতে পারে এইটা। একটা চিকন ছোকড়া আমার কাছে এসে মুখের সামনে একটা সিগারেট এগিয়ে দিলো। অন্ধকারে সে আমাকে কিভাবে দেখলো, আমি তাই চিন্তা করছি। আমি বললাম, “আমার অভ্যেস নেই। ধন্যবাদ।“ ছোকড়াটা বললো, “মানিকদা আপনাকে দিতে বললেন, নিন না”। আমি অবাক হয়ে গেলাম, এই অন্ধকারের মধ্যে সত্যজিৎ রায় আমাকে দেখেছেন? আমাকে দেখে, আবার একটা সিগারেটও পাঠিয়েছেন? আমি রিজেক্ট করতে পারলাম না। ছেলেটা একটা দেশলাই এগিয়ে দিলো। আমি মিথ্যে করে বললাম, “লাগবেনা, আছে”। ছেলেটা হেঁটে চলে গেলো। আমি তো সিগারেট খাইনা। কিন্তু, স্বয়ং সত্যজিৎ সিগারেটটি আমার নামে বরাদ্দ করলেন, আমি কিভাবে না নিই। সিগারেটটি পকেটে ঢুকিয়ে রাখলাম। ব্যাচেলর কামরার ছোট কাঠের শোকেসে দাঁড় করানো রাখবো এইটা।
সত্যজিৎ রায় উঠে দাঁড়ালেন। উনি আমার গা ঘেষে বেরিয়ে যাবার সময় বললেন, “আসো”। আমার এখন হিম হয়ে আটকিয়ে থেকে যাওয়া উচিত, হাতের সব কাগজপত্র হাত থেকে পড়ে যাওয়া উচিত আর ব্যাগটা কাঁধ থেকে ঢলে পড়ে যাওয়া উচিত কিন্তু না। আমার এইসবের মধ্যে একটাও হচ্ছে না। আমি উনার পিছু পিছু এগুতে লাগলাম।
উনি সেট থেকে বের হলেন। উনার বাড়ির পাশেই মুভির সেট বসিয়েছেন। রাস্তা পার করে গেলেই, উনার বাসার সদর দরজা। রায় বাড়ি। যখন স্কুলে পড়তাম, সাইকেল চালিয়ে এই জায়গা দিয়ে যেতাম। প্রতিদিন ঠিক সকাল সাতটায় এক গোয়াল দাঁড়িয়ে থাকতো গেটের সামনে। কিছুক্ষণ পর, গেইট খুলে দেওয়া হতো এবং তিনি ভেতরে ঢুকতেন। আমি এক ফাঁক দিয়ে দেখতে চাইতাম এই বাড়ির ভেতরে কি আছে। কিন্তু, ছোট চোখ আর ছোট বয়সে আমার ছোট মন সেই দরজা দিয়ে ঢুকতে পারতো না। আজ, আমি সেই বাড়ির দরজা দিয়ে ঢুকবো। সত্যজিৎ রায়ের সাথে ঢুকবো। একজন গেইট খুললেন, আমরা দুইজন ঢুকলাম। গেইট দিয়ে ঢুকেই, হাতের বামে একটা ঘর। সেখানে উনি গেলেন। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। ভেতর থেকে দুইজন লোক বের হলেন। একটা টেলিফোন বাজার শব্দ। কেউ একজন সেটা তুলেছে। সত্যজিৎ রায়ের গলা। তিনি কাকে যেনো বলছেন, “কে? ঋতু? হ্যাঁ, আমি ভালো আছি। আচ্ছা, বৃষ্টির জন্য সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখতে পারছো না? হুম, বুঝলাম। তো, কিছুদিন পর গিয়ে দেখবে নাহয়। এই সিনেমা, এতো তাড়াতাড়ি সিনেমা হল থেকে নামবে না। ভালো থেকো”। এই বলে, উনি ফোনটা রেখে দিলেন। আমি খবরের আরও একটি হেইডলাইন পেলাম। “আমার সিনেমা তাড়াতাড়ি সিনেমা হল থেকে নামে না।– সত্যজিৎ রায়”।
সত্যজিৎ রায় বেরিয়ে আসলেন। আমাকে বললেন, “চলো, আমার বাসার জাতীয় ইন্টারভিউ কক্ষে তোমাকে এইবার নিয়ে যাই”। ‘বাসার’, ‘জাতীয়’, এইসব শব্দের সাথে খেয় হারিয়ে ফেলছিলাম। আমি উনার সাথে হাঁটা দিলাম। বিশপ লেফরয় রোডের এই বাড়িটায় কামরার সংখ্যা অনেক হবে হয়তোবা। উনি আমাকে দোতলার উনার স্টাডি রুমে নিয়ে গেলেন। এইবার বুঝলাম, এইটাকে জাতীয় ইন্টারভিউ রুম বলার আসল কারণ কি। আমি যতগুলো উনার ছবি দেখেছি পত্রিকায়, প্রায় তাঁর সবগুলোই এই কক্ষে উঠানো। উনি মশকরা করে জাতীয় বলতে এই কক্ষকে কমন হিসেবে বুঝিয়েছেন। এমন মস্তিষ্ক থেকে বেরিয়ে আসা মশকরা বুঝতেও, তেমন এক মস্তিষ্ক লাগে। সত্যজিৎ, জানালার কাছটায় রাখা উনার চেয়ারে গিয়ে বসলেন। আশেপাশে, এতো অগোছালো বই এতো কাগজ। তারপরেও, খুব দারুণ লাগছে। আমি প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠার পর যখন আমার অগোছালো রুমের দিকে তাকাই তখন যতটা গা গুলিয়ে আসে, এখন ততটাই দারুণ লাগছে। সত্যজিৎ রায়, আমাকে তাঁর ঠিক সামনের চেয়ারটায় বসতে বললেন। উনি বললেন, “তুমি একটু প্রস্তুতি নাও আমি স্ক্রিপ্টটা রিভিশন দিই।” আমি কি প্রস্তুতি নিবো? ট্যাক্সিতে করে অফিস থেকে আসার সময়, ছয়বার প্রশ্নগুলো রিভিশন দিয়েছি। সেটে এসে, চৌদ্দবার সেগুলো কারেক্ট করেছি। নতুন করে, হেডলাইন সাজিয়েছি। নতুন প্রশ্ন এড করেছি। শুধু আমিই না, আমার পেটের মধ্যে দৌড়ানো প্রজাপতিগুলাও আমার থেকে ভালোভাবে প্রশ্নগুলো আয়ত্ত করে ফেলেছে। আমি আর কি প্রস্তুতি নিই? আমি তাকিয়ে দেখছি, সত্যজিৎ রায় বিড়বিড় করে কিছু একটা বলছেন আর স্ক্রিপ্টে কিছু একটা লিখছেন। ঘর শান্ত। বাইরে বৃষ্টি দারুণভাবে বেড়েছে। এক ঠাণ্ডা বাতাস ঘরের ভেতরে আসছে। সত্যজিৎ রায় যেখানে বসা, তাঁর বাম দিকের ডেস্কে রাখা পাহাড়ের মতো স্তুপ জমা কাগজগুলোর একটা দুইটা পাতা হালকা উড়ছে। সত্যজিৎ রায় এখনো লিখছেন। উনি আমার দিকে না তাকিয়ে বললেন, “তুমি এখনো আনন্দতে আছো”? আমি বললাম, “আজ্ঞে, জ্বি”। উনি আমাকে আবার বললেন, “কবে থেকে জয়েন করলে”। আমি বললাম, “আট মাস”। উনি আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন, “তাহলে প্রশ্নগুলো নিশ্চয়ই ‘কেমন আছেন’, ‘এখন কি লিখছেন’, ‘নতুন সিনেমা কি আসছে’, ‘একই নায়ক নিয়েই কেনো সিনেমা বানাচ্ছি’, ‘উমুক নায়িকা কেনো এই সিনেমাটি করলো না’, ‘ফেলুদা কেনো ইদানিং একই রকম লাগে’, ‘শঙ্কু নিয়ে সিনেমা কেনো বানাচ্ছেন না’ ব্লা ব্লা রকমের প্রশ্ন সাজিয়ে এনেছো?” আমি আমার প্রশ্নের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। হুবুহু সব প্রশ্নই দেখছি মিলে গেছে। শুধু ক্রোনোলজিকাল অর্ডার উল্টা-পাল্টা হয়েছে। ওই, নায়িকার প্রশ্নটা শুধু আগে হবে।
আমি বললাম, “মিলে গেছে সব প্রশ্ন”। উনি বললেন, “এই মূহুর্তে বসে অন্য কোনো প্রশ্ন বানাতে পারবে?” আমি বললাম, “আপনি কিভাবে জানতে পারলেন?” উনি বললেন, “অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই কথা বলে।“ আমি মাথায় আরেকটি হেড লাইন পেলাম। “অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই কথা বলে”। উনি বললেন, “সবাই আসে, আর এই রকমই কথা বলে শুধু। আমাকে তুমি একই রকম প্রশ্ন করবে, আমিও তোমাকে একই রকম উত্তর দিবো। মানুষ তোমার পত্রিকা পড়ে, একই রকম স্বাদ পাবে। শুধু, দু’টো কাগজের জায়গায় চারটে কাগজ বিক্রি হবে আমার এই নামটার কারণে। তাইনা কি”? আমি মাথা নাড়িয়ে শুধু হ্যাঁ বললাম। সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা, ছোটবেলা থেকেই প্রাণকে ঠান্ডা করে দেয়,উনার নামের বইটা মনে প্রশান্তি দেয়। এইবার, সত্যজিৎ রায় আমাকে উদ্ধার করে সমাধান দিলেন। উনি বললেন, “সবাই যা করে, তুমি তা করনা। আজ সারাদিন আমি তোমাকে আমার পিছন পিছন যতটা ঘুরিয়েছি, ততটা আমি কোনো সাংবাদিককে সাথে রাখিনি। তোমার কম বয়স দেখেই বুঝেছি, তুমি এখনো পরিপক্ক হওনি। তাই, এক কাজ করো। আজ সারাদিন আমার সাথে থেকে যা যা দেখলে, তাই কালকে লিখে দাও। দেখো, মানুষ বেশী পড়বে। আমাদের জীবন সূর্যের মতো। সবাই বাইরে থেকে দেখে, আমরা জ্বলছি। তারপর, তারা ভেতরে যেতে চায় কিন্তু তাপে আর কাছে যেতে পারে না। তুমি কিছুটা এবার কাছে নিয়ে যাও। হেডলাইন দাও……” উনি কিছুটা আটকিয়ে গেলেন। হাতের ঘড়ি দেখে বললেন, “যেমন ধরো এখন বিকেল চারটা বাজে, সেই হিসেবে হেডলাইন হতে পারে ‘একদিন বৃষ্টিতে বিকেলে’। আই এম জাস্ট সাজেস্টিং।“ আমি বললাম, “জ্বি, আচ্ছা”। উনি বললেন, “চলো, বাসার পেছনের জায়গাটায় সেট পড়েছে। শেষ সময়টুকুও থাকো”। এই বলে, সত্যজিৎ রায় উঠে দাঁড়িয়েছেন। আমিও উঠলাম। উনি দরজার পেছন থেকে ছাতা নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। আমি আমার ঘাড়ের ব্যাগ মাথায় ধরলাম। উনি লম্বা পায়ে হেঁটে এতোক্ষণে অনেকদূর চলে গেছেন। আমি পেছনে হাঁটা দিলাম।
বাসার এই দিকটায় কিছুটা জঙ্গলের মতো। ক্যামেরা পলিথিনে ঢাকা আছে, আর ক্যামেরাম্যানকে খুব উত্তেজিত মনে হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর সত্যজিৎ রায়কে আর দেখতে পেলাম না। আমাকে বসার জন্য একটা চেয়ার দেওয়া হয়েছে। নাকে দারুণ একটা সুগন্ধি এসে লাগলো। বৃষ্টির পর মাটি থেকে উড়ে আসা গন্ধ না। কৃত্রিম গন্ধ। দেখলাম, কিছুদূরে নায়িকা শর্মিলা বসে আছেন। উনি হয়তোবা কফি খাচ্ছেন ট্রান্সপারেন্ট গ্লাসে। চা এর লিকার এতো ঘন না হবার কথা। আমি চারপাশে তাকিয়ে আছি। হঠাত দেখলাম, সত্যজিৎ রায় ট্রলির উপর বসে আছেন। উনি উনার মাথায় ছাতাটা ধরে রেখেছেন। এক অজানা দৃষ্টিতে তাকানো। আমি আমার ব্যাগ খুললাম, খুব সাবধানে। এক ফোঁটা পানির বিন্দু যেনো ভেতরে না ঢুকে। পলিথিনে মুড়িয়ে রাখা ক্যামেরাটা বের করলাম। তাক করলাম, সত্যজিৎ রায় এর দিকে। উনি একই অবস্থানে বসা। আমি ফ্রেম ঠিক করে, একটা শর্ট নিবো বলে শাটারে চাপ দিতে যাবো এমন সময় কেউ আমাকে এক পাশ থেকে ডেকে উঠলো। “বাবু, চা”। আমি লোকটার দিকে তাকালাম। একজন টাকওয়ালা স্বাস্থ্যবান মানুষ, গায়ে পরটার রঙের ফতুয়া আর ঘাড়ে একটা গামছা। আমি উনার দিকে তাকিয়ে কাপ হাতে নিয়ে বললাম, “এইটাকি রায় বাড়ির চা”? উনি বললেন, “আজ্ঞে, জ্বি”। তারপর উনি চলে গেলেন। আমি দেখলাম, “চায়ের রঙ কফির মতোই অনেক গাঢ়। শর্মিলার হাতের কাপের কফির মতো অনেকটাই। আমি চায়ের কাপটা নিচে নামিয়ে রাখলাম। বৃষ্টির ফোঁটা সেটার মধ্যে পড়তে থাকলো। আমি আবার, সেই ট্রলির দিকে তাকিয়ে দেখি সত্যজিৎ একইভাবে বসে আছেন। শুধু ছাতাটা উনার পাশে আধা শোয়ানো। উনি হয়তোবা বৃষ্টি শেষ হবার জন্য অপেক্ষা করছেন। আমি আবার ক্যামেরায় মনমতো একটা ফ্রেম নিয়ে ক্লিক করলাম। একটা ক্লিক, একটা দিন শেষের মূহুর্তের মতো।
পরের দিন পত্রিকায় আমার লিখা বেরিয়েছে। তার সাথে, আমার তোলা এই ছবিটি। আজ হয়তো, সত্যজিৎ রায়ের বাসার সামনে হকার খবরের কাগজ দিতে গিয়েছে। সত্যজিৎ রায়ের হাত অবধি হয়তো কাগজটা পৌঁছিয়েও গিয়েছে। উনি হয়তোবা হেডলাইন দেখে মুচকি হেসেছেন। এতে লেখা, “একদিন বৃষ্টিতে বিকেলে”।
এই গল্পের সকল প্রেক্ষাপট পুরোপুরি কাল্পনিক।
Ray sitting on a trolley, on location in Bolpur, West Bengal, during a break from filming Asani Sanket (Distant Thunder). Photo: Nemai Ghosh
Rajiul Huda Dipto is a professional screenplay writer and working for years in the Bangladeshi TV industry. Besides that, he introduces himself as a photographer, whose photographs have been featured in various magazines and exhibitions all around the world. Not regularly, but he publishes his works in national dailies as well. Currently, he is working as a community writer in BuzzFeed and a contributor in Getty Images.
গোসল থেকে বের হয়ে শাড়ির আঁচল ঠিক করছে শায়িরা। শাড়ির আঁচল ঠিক করা খুব সহজ কোনো বিষয় না। ভাঁজের দিকে বিশেষ মনোযোগ দিতে হয়। আঁচলের ভাঁজ একের সাথে আরেক লেগে গেলেই সমস্যা। একদম টানটান আর আলগা হওয়া লাগে। ছোটবেলায় খেলার ছলে মায়ের শাড়ির আঁচল ঠিক করতে গিয়ে পুরো বিষয়টি আয়ত্ব করে ফেলেছে সে। মাথায় বেণী করে কাকভেজা চুলে আকাশী তয়লা জড়িয়ে রেখেছে, মায়ের মতো। কোমরের নিচ অবধি চলে গিয়েছে চুল শৃঙ্খলার সাথে। আঁচল ঠিক করতে করতেই নাক শিঁটকোয় শায়িরা। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির সময় আশেপাশের ময়লার গন্ধ জীবন্ত হয়ে ওঠে। তীব্রতার সাথে নাকে ঢোকে।
ইলিশ মাছের আঁশটে গন্ধ তার নাকে ঢুকছে, খোলা জানালাটা দিয়ে ভেতরে আসছে গন্ধটা। সে তার আঁচল ঠিক করায় মন দেয়। সাথে এইটা ভেবে বিরক্তি হয় যে, কাজের বুয়া আজ যাবার সময় আঁশটে বাড়ির পাশেই ফেলে এসেছে। খুব বিরক্তকর।
কলিংবেলটা বেজে ওঠে। খুব তাড়াহুড়োয় আছে এমন কেউ বেলটা বাজায়নি। বেশ কিছুক্ষণ চেপে রেখে তারপর সুইচ থেকে আঙুল সরানো হয়েছে। এই সময় আবার কে এলো? বুয়া কি কালকের ভাতগুলো নিয়ে যেতে ভুলে গেলো? কিন্তু, সে তো এতো ধীরস্থিরভাবে বেল চাপেনা। আর, একসাথে গুনে গুনে চারবার টেপে। তাহলে কি ফয়সাল? সে এই সময় কেনো আসতে যাবে? সেও তো চটজলদি অবস্থাতে বেল চাপে। এতো ধৈর্য তার নেই। গুনে গুনে দুই বার। কিন্তু, এতো খুব ধীরে চেপেছে, তাও আবার একবারই চেপে আর কিছু বলছে না। পাড়ার বদমাস বাপ্পি কি বেল চিপে পালিয়ে গেলো? তাও আবার এই বৃষ্টিতে?
শায়িরা এতোকিছু ভাবতে ভাবতে দরজা পর্যন্ত যায়। মাথাতে বেণী করা তয়লাটা পেছনে ঝুলছিলো। সে সামনে করে নেয়। গালের পানির ফোঁটাগুলো হাত দিয়ে মুছে ফেলে। তারপর দরজা খোলে। আধুনিক যুগের দরজা নয়। উপরে সিঁকি দেয়া দরজা। সিঁকিটা নিচে পড়ে গেলে ‘ঠক’ করে একটা শব্দ হয়। সামনে রাহাত দাঁড়ানো। পুরোদস্তুর ফরমাল গেটআপ পরানো। চুলগুলো দেখলেই বোঝা যায় সিঁথি করা ছিলো। বৃষ্টি আর দক্ষিণ কোণের বাতাস এলোমেলো করে ফেলেছে অনেকটাই। চোখে চশমা আগের মতোই। চেকচেক নীল শার্ট, ব্যাংকাররা যেমন পরে। শায়িরা দু’হাতে দরজার দু’টি দিক ধরে দাঁড়িয়ে আছে। বাইরে প্রচন্ড শীতল অসভ্য বাতাস। খুব ঠান্ডা লাগা শুরু করেছে তার। তবে, শাড়ির আঁচলের কোনো সমস্যা হচ্ছে না। বিশ্রিভাবে পেট থেকে শাড়ির কিছু অংশও সরে যাচ্ছে না। সত্যিই শাড়ি পরাটা বেশ ভালো করেই আয়ত্ব করতে পেরেছে শায়িরা। তবে, শায়িরার পেট গুড়গুড় করছে। হৃদকম্পন অনেকটা বেড়ে গিয়েছে বললে, খুব তথাকথিত বিষয় হয়ে যাবে। তার হৃদকম্পন শিথিল হয়ে গেছে। ভ্রু কপালের ভাঁজের মতো কুঁচকে গেছে।
“তোর বাসা?”, অপ্রস্তুতি আর উৎকন্ঠা জড়িত কন্ঠে বলে ওঠে রাহাত। “হ্যাঁ”, বলার সাথে সাথেই শায়িরার ঠোঁটের উপরের তিলটা কেঁপে ওঠে। রাহাত বলে, “কেমন আছিস?” শায়িরা বলে, “তুই হঠাৎ এইখানে?” রাহাত হাতের কাগজের ফাইল দেখিয়ে বলে, “আসলে একটা ডকুমেন্ট দেয়ার ছিলো ফয়সাল নামের এক ভদ্রলোককে।” তারপর সে ফাইলের উপর লেখা ঠিকানাটা পড়ে বলে, “এইখানে ঠিকানা তো এইটাই দেয়া আছে।”
“নাম-ঠিকানা ঠিকই আছে”, বলে শায়িরা। বাইরে দমকা হাওয়া আরো বেড়ে যায়। শুধু রাহাতেরই না, দরজাটা খুলে দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে শায়িরারও। রাহাত ফাইলটা শায়িরার হাতে দেয়। শায়িরা ফাইলটা হাতে না নিয়ে বলে, ” এখনতো যেতে পারবি না। ভেতরে আই।” রাহাত ভেতরে যায়। শায়িরা দরজা লাগিয়ে দেয়।
“বস,” বলে শায়িরা।
“থ্যাংক ইউ,” বলে সিংগেল সোফাটায় গিয়ে বসে রাহাত। শায়িরা এতোক্ষণে নিজেকে অনেকটাই সামলে নিয়েছে। টানা পাঁচ বছর বাদে রাহাতের সাথে দেখা। অনেক কিছু পাল্টে গেছে এতোগুলো দিনে। পাল্টেছে দু’জনেরই উপলব্ধি। বৈজ্ঞানিক এক গবেষণার ফল বলে, টানা ছয় মাস আপনার অতি আপনজনকে না দেখে থাকলে আবছা হয়ে তার চেহারা আপনার মাথা থেকে চলে যায়। এক বছরে গিয়ে তা আরো প্রকট হয় আর ধীরে ধীরে এটি তীব্রতর হয়। পাঁচ বছর, অনেক সময়। চেহারা ভুলে গিয়েও, কয়েক সেকেন্ডের দেখায় আবার পুরোটা মনে পরে গেছে দু’জনেরই।
শায়িরা বলে, “ফয়সাল আমার হাজবেন্ড।” রাহাত বলে, “ও।”
– “ফাইলটা কিসের?”
– “উনি তো লোনের জন্য এপ্লাই করেছিলেন বেশ কিছুদিন আগে।”
শায়িরা ফাইলটা হাতে নিয়ে দু’একটা পাতা উল্টিয়ে বলে, “হয়ে গেছে?” রাহাত বলে, “না, কিছু কারেকশন আছে। সেটা উনাকেই করতে হবে। তাই, ফাইলটা উনাকে দিতে আসা।”
– “তুই তাহলে লোন ডিপার্টমেন্টে আছিস?”
– “না। আসলে ফাইলটা আমার দিতে আসবার কথাই নয়। আমার জুনিয়র আবু তার দেয়ার কথা। আমিতো এই ব্রাঞ্চেই কাজ করিনা। চট্টগ্রামে আছি। আজ একটা কাজে এসেছিলাম। আবু আমার খুব কাছের। সে প্রচন্ড ব্যস্ত ছিলো, ভাবলাম আমার যাওয়ার পথেই পড়বে যেহেতু ওর কাজটা কমিয়ে দিই।”
– “পরোপকারিতা আজও যায়নি তাহলে?”
– “আজ পরোপকারিতার জন্যই কিন্তু তোর সাথে দেখা হয়ে গেলো। পাঁচ বছর পর।”
– “তুই না বলেছিলি, কখনো দেখা করবিনা?”
– “হুম। তুইও কি চেয়েছিলি?”
– “হয়তো। চা খাবি?”
– “না, আমার এক ঘন্টা বাদেই ফ্লাইট। চট্টগ্রাম গিয়েই লাঞ্চ করবো।”
– “এতো বৃষ্টিতে যাবি কিভাবে?”
– “গাড়ি আছেতো।”
– “এইখানেই লাঞ্চটা করে যা।”
– “এর আগে যতবারই তোর বাসায় গিয়েছি, আমার কিন্তু লাঞ্চটা করা হয়নি।”
রাহাত বারণ করতে যাবে। শুনলোনা শায়িরা। পিঠ দেখিয়ে ডাইনিং এর দিকে চলে গেলো সে। ফাইলটা হাত থেকে টেবিলে রেখে চারপাশে তাকালো রাহাত। খুব যত্নের সাথে পুরোনো বাড়িটাকে নতুন করে সাজানো হয়েছে। দেয়ালে বেশ বড় একটা টিভি, অনেকগুলো সোফা। ডাইনিং পাশেই। রান্নাঘরটা দেখা যায়। সোজা তাকালে হয়তো শোবার ঘর দেখা যাচ্ছে। হাতের বামে মেইন দরজা পার করে আরেকটি ঘর মনে হচ্ছে। রান্নাঘরের পাশেই কি বারান্দা? যেমনটা শায়িরা চেয়েছিলো। মনে প্রশ্ন জাগে রাহাতের। তবে, শোবার ঘরের উল্টো পাশ দিয়ে একটা সিঁড়ি চলে গেছে উপরের দিকে। সেটা কি উপর তলার সিঁড়ি না কি ছাদে যাবার? ঠিক শায়িরা যেমনটা চেয়েছিলো।
শায়িরা পায়েস নিয়ে এসেছে। সাথে ফালুদা আর দু’টো মাছ ভাজা। রাহাত একটু হেসে বলে, “মাছা ভাজা?” শায়িরা বলে, “হুম। তোর কত প্রিয়। আর দেখ, কাকতালীয়ভাবে আজকেই ভাজলাম।”
রাহাত বলে, “পায়েস আর ফালুদা কি তোর বানানো?” শায়িরা বলে, “হ্যাঁ।” পায়েসটা মুখে দিয়ে রাহাত বলে, “একদম তোর মায়ের মতো হয়েছে। শ্বশুর বাড়ি পাঠানোর আগে নিশ্চয় হাতে কলমে শিখিয়েছেন উনি।” এরপর ফালুদা মুখে দিয়ে রাহাত বলে, “মিষ্টি বেশ কমিয়ে দিয়েছিস। ফালুদা বানানো ভুলে গেছিস নাকি?” শায়িরা বলে, “না, আসলে ফয়সাল বেশী মিষ্টি পছন্দ করে না। তাই, একটু ধরন পাল্টাতে হয়েছে।” “আচ্ছা,” বলে রাহাত।
শায়িরা মাথার তয়লাটা খুলে এসেছে। মেয়েদের চুল ভিজে থাকলে কুঁকড়ে থাকে। সেরকমই হয়ে আছে শায়িরার লাজুক চুল। ডান চোখের ঠিক পাশটা দিয়ে বেয়ে গেছে চুলের দেয়াল। আরো উজ্জ্বল লাগছে শায়িরাকে। আরো পরিপূর্ণ। দেখলেই বোঝা যায়, ভালো আছে শায়িরা। সবই আছে, পেয়েছে সবকিছুই। কিন্তু, কোনো মানুষের জীবনতো সম্পূর্ণভাবে পরিপূর্ণ হয়না। না পাওয়ার মধ্যে রাহাতকে পাওয়াটাই বাকি থেকে গেছে হয়তো।
“কেমন হয়েছে মাছ ভাজাটা?” জিজ্ঞেস করে শায়িরা। রাহাত বলে, “দুর্দান্ত। হাল্কা আঁচে বেশ কড়া করে ভাঁজা।” শায়িরা বলে, “যাক, সন্তুষ্ট করা গেছে দেখছি তোকে তাহলে।”
– “একটা প্রশ্ন করি।”
– “কর।”
– “তোর রান্নাঘরের পাশে কি বারান্দা?”
– “কিভাবে বুঝলি?”
– “তুই সবসময় চায়তি এমনটা হোক, তাই ভাবলাম পেয়েছিস কি না।”
– “হুম, পেয়েছি।”
– “সিঁড়িটা বেয়ে কি ছাদে যাওয়া যায়?”
– “না, উপরে বাবা-মা থাকতেন। দুই বছর হলো উনারা মারা গেছে।”
– “তাহলে এই পাওয়াটা পূরণ হয়নি।”
– “সব পাওয়া কি পূরণ হয়?”
– “নাহ।”
– “তবে উপর তলাটা পার করেই ছাদ।”
– “কতগুলো গাছ আছে ছাদে?”
– “অনেকগুলো গাছ। বেশ কয়েকদিন থেকে যত্ন করাই হচ্ছিলোনা। বৃষ্টিটা হয়ে ভালো হয়েছে।”
হাসতে শুরু করে রাহাত। এরমধ্যে মধ্যস্থতা বৃষ্টি কমে এসেছে। রাহাত বলে, “আমাকে যেতে হবে। ফ্লাইটের সময় হয়ে আসছে প্রায়।” শায়িরা বলে, “তোর না এরোফোবিয়া ছিলো? বিমানে চড়তে ভয় পেতি।” হাল্কা হেসে রাহাত বলে, “ভয় তো তোকে হারানোরও পেতাম। হারাতে তো হলোই।” শায়িরা বলে উঠে, “এতোদিন বাদে দেখা হলো। এখনো অভিমান আমার উপর।”
– “অভিমানটা হয়তো সময়ের উপর।”
– “আমাদের কি কোনো দোষ নেই?”
– “ঘুণাক্ষরেও যার কথা ভাবিনি, তাকে হঠাৎ করে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। সেও বেসে ফেলেছিলো। দোষটা কোথায়?”
– “জানি না।”
– “আমি আজ এসেছিলাম, তোর জামাইকে বলবি?”
– “কেনো বলবোনা?”
– “ওকি আমাদের ব্যাপারটা জানে?”
– “তোর বউ জানে?”
– “হুম, জানে।”
– “একটু বস। চা বসিয়েছি।”
– “আজ আর খাবো না। দেরী হয়ে যাচ্ছে খুব।”
– “আচ্ছা। আমি আসছি।”
শায়িরা প্লেটগুলো নিয়ে ভেতরে চলে গিয়ে চুলো বন্ধ করে বেরিয়ে আসে। রাহাত উঠে দাঁড়িয়েছে আগেই। দরজার কাছে দাঁড়ানো আছে। শায়িরা গেইট খুলে দেয়। রাহাত বলে, “তোর মনে আছে আমাদের দেখা হলেই আমার সবচাইতে অপছন্দের বিষয় কি ছিলো।” শায়িরা বলে, “বিদায় জানানো।” রাহাত বেরিয়ে বলে, “আজও তাই। চলি।”
একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে গেটের কাছেই। রাহাত সেটায় উঠে পড়েছে। শায়িরা বলে, “ভালো থাকিস। আল্লাহ হাফেজ।” খুব কষ্টে গালের কোণে এক চিলতে হাসি দেখা যায় রাহাতের। গাড়ি চলতে শুরু করে৷ প্রচন্ড ঠান্ডা। গাড়ির মধ্যে এসি চলছে। দাঁতে দাঁত চিপে বসে থাকে রাহাত। চোখে চোখ চেপে বসে থাকতে পারেনা সে। একটু ভিজে আসে কোণটা।
শায়িরা কেবল দরজাটা লাগিয়ে ভেতরে গেছে। টেবিলের উপর রাহাতের রেখে যাওয়া ফাইলটা পড়ে আছে৷ সে ফাইলটা তুলে নিয়ে তার শোবার ঘরে যায়। একবার খুলেও দেখে না। বিছানার উপর ফেলে রাখে সেটা। এরপর ফাইল কেবিনেটের প্রথম ড্রয়ারটা খুলে একটা ফাইল বের করে। বিছানায় পরে থাকা ফাইলটার কাছে এসে রাখে।
রাহাতের দেয়া ফাইলটার প্রথম পাতা খোলে শায়িরা। ব্যাংকের নাম যে জায়গাটায় লেখা, তার পাশে একটা কালো কালির টান। হালকা আঁচড় লাগলে যেমনটা দেখায় সেরকম। এবার ফাইল কেবিনেট থেকে বের করা ফাইলটার প্রথম পাতা খোলে শায়িরা। এইখানেও ব্যাংকের বড় করে লেখা নামটার পাশে একটা কালির দাগ, একইরকম দাগ। দু’টো ফাইলেরই পাতা ওল্টাতে থাকে শায়িরা। কাগজের মার্জিন থেকে শুরু করে লেখা সবকটি ফিগার, সবকিছুই হুবুহু একই। মুচকি হেসে ওঠে শায়িরা।
কিছুদিন আগে লোনের এই কাগজটা ব্যাংক থেকেই বাসায় দিয়ে গেছে। শায়িরা নিজেই রিসিভ করেছে৷ আজ যখন সে রাহাতের কাছ থেকে ফাইলটা পায়, সে জানতো এইটা সেই ফাইল। হুবুহু সেটাই। সে জানতো, রাহাত কোনো ফাইল দিতে আসেনি। শুধু এসেছিলো তাকে দেখতে। রাহাতের থেকে যাওয়া পুরো সময়টা জুড়ে শায়িরা জানতো এই সবকিছুই। তবুও, সে কিছু বলেনি। কেনো বলবে? তারও তো তাকে দেখতে ইচ্ছা করছিলো৷ কেনো বলবে? সেও তো চেয়েছিলো রাহাত আসুক তার পছন্দের নীল রঙের চেকচেক শার্ট পরে। কেনো বলতে যাবে সে? শায়িরা তো নিজেই চেয়েছিলো দু’জন মিলে বৃষ্টিতে ভিজতে। হোক না সেটা দরজায় দাঁড়িয়ে ঠিক দু’জন অচেনার মতো।
শহরটা আবার ভিজে একাকার। গলির মোড়ে রাস্তাটায় পানি জমেছে, বৃষ্টি কমেছে। বাইরে লোকজন বেরিয়ে এসেছে। আবছা হওয়া জানালার কাঁচে গুটিগুটি দানা বেঁধেছে বৃষ্টির পানির দাগ। বিকেল বেলাটা বুড়িয়ে গেলো কেমন করে। বয়স বেড়ে সন্ধ্যা হয়ে এলো আবার। টেবিলের খাবারগুলো জমে ঠান্ডা। ডাল তার স্বাদ হারিয়েছে ঠান্ডা হয়েই। ভাতগুলো ঠিক মনের মতোই শুভ্র শ্বেত। চেয়ারগুলো ফাঁকা পড়ে আছে। ছাদের গাছগুলো এতোটা ভিজতে চায়নি হয়তো। রান্নাঘরের বারান্দাতে পুরোনো যত চেয়ার-টেবিলে ঘুণ পোকারাও ভিজে একাকার। দম নিচ্ছে একটু করে। ডিসওয়াশারে একাকী প্লেট পড়ে আছে নিজের মতোই। চা ফুটলো ঠিকই, তবে ঢালা হলোনা প্রিয় কাপটায়।শাড়ির আঁচল জীবনের মতোই নিয়ম মাফিক রয়ে গিয়েছে। সিংগেল সোফাটার কুশন এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে। চুলগুলো যেই না শুকাতে চায়লো, বেজে উঠলো কলিংবেল। আবারো দরজা খোলার আশায়, আবার বেজে উঠলো কলিংবেল। দরজা খুলেই যাকে প্রতিবার দেখতে চাই, সে আসবে বলে হয়তো বাজলো একটি কলিংবেল।
Rajiul Huda Dipto is a professional screenplay writer and working for years in the Bangladeshi TV industry. Besides that, he introduces himself as a photographer, whose photographs have been featured in various magazines and exhibitions all around the world. Not regularly, but he publishes his works in national dailies as well. Currently, he is working as a community writer in BuzzFeed and a contributor in Getty Images.
ওই ঈদ, এই ঈদ আর সেই ঈদ। কেউ ছিলেন, কেউ আছেন আর কেউ থাকবেন। কারো খাসি গতবার মোটাতাজা বেশী ছিলো, কারো ভেড়ায় এইবার লোম বেশী আর সামনে বার কেউ কালো গরুর সাথে সাথে বাজারের সবচেয়ে লম্বা উট টাও কোরবানী দিবেন বলে ঠিক করেছেন। কেউ গতবার কাবুলি পড়েছিলেন বলে এই ঈদে কিছু কিনছেন না, এইবার হয়তো কারো বাসায় যে কর্তা কাপড় কিনে দেন তিনিই থাকচ্ছেন না আর সামনে বার কেউ হয়তো ব্লেজার পড়ে ঈদগাহে যাওয়ার কথা ভাবছেন।
ঈদের রাতটা অতীত স্মৃতি কে অন্যান্য দিনের তুলনায় বেশী চাঙা করে তোলে। সাথে সাথে ভবিষ্যৎটার উপরেও ভয়, উতকন্ঠা ও আশার প্রলেপ মুড়ে দেয়। তবুও, সব কিছুর মাঝেও সব কিছু ভুলে গিয়ে যখন ঈদের দিন সকালে স্যান্ডেলের খস খস শব্দ আর আতরের গন্ধে নেশাগ্রস্থ হয়ে মুখে, ”আল্লাহুআকবার আল্লাহুআকবার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, আল্লাহুআকবার আল্লাহুআকবার ওয়ালিল্লাহেল হামদ” বলে ঈদগাহে যাই তখন চেতন মন অচেতন মনকে বারবার এইটাই বলতে থাকে “কেউ আছেন ওই উপরে কেউ আছেন।”
প্রতিটা ঈদ ই নতুন ঈদ। আর নতুন ঈদ গ্রহণ করাতো পবিত্রতার মধ্যে পড়ে। জীবনে যাই চলুকনা কেনো,চেষ্টা করুন যেন প্রতিটা দিন ঈদের মতো কাটে তাহলেই দেখবেন সুখ ওই কল্পনার আয়না থেকে বের হয়ে আসবে। সবাইকে ঈদ এর শুভেচ্ছা, ঈদ মোবারক।
Rajiul Huda Dipto is a professional screenplay writer and working for years in the Bangladeshi TV industry. Besides that, he introduces himself as a photographer, whose photographs have been featured in various magazines and exhibitions all around the world. Not regularly, but he publishes his works in national dailies as well. Currently, he is working as a community writer in BuzzFeed and a contributor in Getty Images.
শাড়ির লাল পাড়ে ঢেউ খেলানো শুভাসী,
হারিকেনের কাঠিটা মধ্যখানে অবস্থান করছে। বাসা থেকে দূরে আছি, তাই রাতের বেলা বাবার সেতারে তোলা বৃন্দাবানী সারাং এর আওয়াজ আর কানে আসে না। আসে শুধু ঝি ঝি’র ডাক। এই ডাককে সারাং এর তালের সাথে relate করার চেষ্টা করি। জোর করে। ‘জোর’ শব্দটা শুনলেই সেই ৮ বছরের বাচ্চা মেয়েটার কথা মনে আসে।
বাবলার চরের ফাটা জমির উপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে বাসায় ফিরছিলাম। থেমে গেলাম। আসলে থেমে যেতে হলো। ফাটা জমির আইলটার পাশে বসে ছোট্ট সবুজ চারা মাটি দিয়ে দেবে দিচ্ছিলো মেয়েটা। খুব যত্ন করে করছিলো। বোঝা গেলো, এই মেয়ে যা করে খুব যত্ম নিয়ে করে। বড় হয়ে নিশ্চিত চারুকলায় ভর্তি হতে পারবে। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম। পায়ে জোরে জোরে চাপ দিয়ে হাঁটলে যেমন ধাপ ধুপ ধাপ ধুপ আওয়াজ হয়, তেমন একটা আওয়াজ আমার কানে এলো। বাম পাশ ফিরে তাকালাম লাইন ধরে অনেক মানুষ আইলের উপর দিয়ে হেঁটে আসছে। প্রথমে ভাবলাম মেলার লোকবল। সামনে সেই শুকনো খিটখিটে লোকটা এই মেয়েটার সবুজ চারার উপর পা দাবিয়ে চলে গেলো। তারপর একে একে সবাই। নিশ্চিত হলাম, মেলা নয় অন্য কিছু। মেয়েটা তখনো বসে আসে। হঠাত একজন মধ্যবয়স্কা মহিলা, মেয়েটার এক হাত ধরে টান দিলো। ইসস! হাত খুলে যাবে মনে হলো। মেয়েটার সাদা জামার হাতের কুঁচিটা ছিড়ে গিয়েছে। সে কাঁদছে। ‘জোর’ করে তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
শুভাসী আমার ৬০০ টাকার চাকরী, তোমার হাতের চুড়ির সাথে আমার পাঞ্জাবী হাতার অহেতুক লেগে থাকা বাঁধন আর প্লেটে আম্মার মাখা ভাতের অর্ধেকটা সেদিন ফেলে কেনো চলে এসেছিলাম জানো? আমি চেয়েছিলাম সেই বাচ্চা মেয়েটা যেনো বড় হয়ে চারুকলায় ভর্তি হয়। স্বাধীন এক চারুকলায়। যে চারুকলায় সে পহেলা বৈশাখের প্রস্তুতি স্বরূপ যত্ন নিয়ে maskot বানাবে রাস্তায় ভিন্ন ভাষায় কথা বলা পুলিশের বেরিকেটের ভয় না করে। আমার হাতে স্টেইনগানের বদলে, আমি তার হাতে তুলি দেখতে চেয়েছিলাম।
হারিকেনের তেল শেষ হবে হবে হয়তো। না, অন্যান্য দিনের মতো আজকে বৃষ্টি হচ্ছে না। আমার মন খারাপ থাকলে বৃষ্টি হয়না। আজ আমার মন খারাপ। কারণ, আজ তোমাদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। যেখানে শেষ সেদিন তোমার চুড়ির সাথে লাগা আমার সাদা পাঞ্জাবীর হাতার অহেতুক বাঁধন খুলে চলে এসেছিলাম সেই গাব গাছটার নিচে গিয়েছিলাম। গাব গুলো গোলাগুলির ভয়ে গুটিসুটি মেরে বসে আছে। একটাও মাটিতে পড়ে নাই। আমাদের হাজার সন্ধ্যার সাক্ষী যে ছোট ব্রীজটা। আরে সেই ব্রীজটা, যেখানে ছোটবেলায় তুমি আর আমি পানিতে পাটকেল ফেলার competition করতাম। তারপর কলেজে উঠে আমরা পানিতে ফেলতে লাগলাম বাদামের খোসা। কলেজের শেষের দিনে আমরাই পড়ে গেলাম…..পানিতে নয় বরং প্রেমে। যে ব্রীজটাই দাঁড়িয়ে তোমার সাথে প্রেমে পড়েছিলাম, সেই ব্রীজটার কথা বলছি। ওটা আর নেই। উড়িয়ে দিয়েছি। গ্রেনেডের চাবিটা আমি খুলেছিলাম। শুভাসী, কি কষ্ট হচ্ছিলো আমার জিজ্ঞেস করবে না। দু’ফোঁটা নোনতা জল আমি ঠেকিয়ে দিচ্ছি এই বাক্যের শেষ দাঁড়িটায়, ছুঁয়ে দেখো এর উত্তাপ। সেই ব্রীজের উপর দিয়ে আসার সময় পাকি uniform পড়া দানবগুলো বোমার আঘাতে যখন উত্তপ্ত হয়ে জীবনের শেষ দিন দেখছিলো, সেই উত্তাপ অনুভূত হতে পারে তোমার হাতে।
এই ব্রীজ অপারেশনেই গিয়েছিলাম তোমাদের বাড়ির দিকে। একটা ভাঙা তালা ঝুলানো। বারান্দার মেঝেটা ঠান্ডা ছিলো। এতো ঠান্ডা আমি তোমার সামনে এসেও কখনো অনুভব করিনি। তোমাদের মেহমান বসার ঘরে ৯৯ টি রবের নামের যে পোস্টার, তার উপর হাত বুলিয়ে এসেছি। কতদিন আম্মা কোরআন পড়ে বুকে ফুঁ দিয়ে দেন না। সেটা স্পর্শ করে চোখ বন্ধ করে নিতেই মনে হলো আম্মা বলছেন,”কই দেখি এইদিকে আই।”
তোমাদের খাবার টেবিলের এক কোণায় পায়েস পড়ে ছিলো। লাল পিঁপড়ারা জেকে বসেছিলো। খালাম্মার রান্না করা পায়েস। আমি পিঁপড়া সরিয়ে চেখে দেখেছি। এক সপ্তাহের ক্ষুধা এক চিলতিতে মরে না। পাছে পিঁপড়াগুলার সংসার নষ্ট করে দিয়ে আসলাম। বেশীক্ষন থাকতে পারিনি। গুমোট বাড়িটাই তোমার ব্যবহার করা সুগন্ধির গন্ধ আমাকে তোমার ঘরের দিকে টানছিলো। উলটা রথের দিনে আমার কিনে দেয়া সুগন্ধি। তোমার হেচকা টানে, একটুর জন্য যেটা ভাঙতে বসেছিলো সেই সুগন্ধি। তোমার ঘরের দিকে পা বারাতেই কমান্ডার ইউনুস হাঁক মারলেন। বেরিয়ে গেলাম। তোমরা বাড়ির এইভাবে সব কিছু রেখে চলে গেছো দেখে একটু অবাক হলাম। আবার ভাবলাম, জীবন তো অমূল্য। যা গেছে আবার আসবে, জীবন নয়। কোথায় গেছো, কেমন আছো কিছু জানিনা। স্বাধীনতা খুঁজে পাওয়ার পর, তোমাদের খোঁজা শুরু করবো।
যে কলমটা দিয়ে তোমাকে লুকিয়ে লুকিয়ে লিখছি, সেটি কমান্ডারের নকশা করার কলম। উনি খুঁজছেন। এতোক্ষণ হৃদয়ের নকশা আঁকা হলো, এবার হৃদয়ে বাস করা মানচিত্রের মুক্তির নকশা আঁকা হোক। যেখানেই থাকো, রাতের নগ্ন জোছনা দেখার জন্য হুটহাট বের হয়ে যাবানা। মুক্তিটা খুঁজে পাই, তোমার হাত ধরে একসাথে জোছনা মাটিতে নামিয়ে আনবো। সবুর করো।