
যে কুয়াশায় ভয় ছিলো (The fog of fear)
প্রিয় তুমি,
মনে আছে তোমার আঙুল জড়িয়ে রাখা শক্ত আঙুলটা কে? তোমাকে চিঠি লেখার স্বার্থে আজ সেই আঙুল আর অন্য কারো হাত ধরতে না পেরে ঝরনা কলমটা কে জড়িয়ে রেখেছে। সেই দিন আমার কালো রঙের জ্যাকেট, তোমার কালো রঙের শাল যেভাবে জড়িয়ে ছিলো আমাদের শরীর দুটো।
সামনে দিক অন্ধকার ছিলো। সোনালী ঘাস ছিলো ভেজা, শিশিরের অত্যাচারে। বাসায় মিথ্যে কথা বলে আমরা যে জায়গাটায় গিয়েছিলাম সেটা নাকি কোনো এক রাজার দালান ছিলো যেখানে রানি তার জন্য অপেক্ষা করতে করতে পার করেছেন এই মায়া নগরী। তার মৃতদেহ নাকি পাওয়া গিয়েছিলো জানালায় মাথা রাখা অবস্থাতেই। সে জানালায়, যে জানালা দিয়ে ভেতরে আসার পথটা ভীষণ স্পষ্ট দেখা যায় । জানিনা আমি ঠিক মতো, জানার প্রয়োজন কার ছিলো পুরনো ইতিহাস। আমিতো তখন তোমার চোখে আমার ভবিষ্যৎ দেখার স্বপ্নে বিভোর। আর তুমি তোমার টা আমার টায়।
পরিত্যক্ত কালচে সবুজ দালানের গা দিয়েও ঘাম ঝড়ছিলো। সেই ভাবে, যে ভাবে শীতের সকালে বেরসিক বেমানান রোদ উঠলে আমার ব্যাচেলর লাইফের সস্তা ফ্ল্যাটের ছোট জানালার কাঁচ ঘামতো। তুমি কাঁপছিলে, শুকনো শরীর আর কতটাই সইতে পারতো তখন। আর আমি? ছেলে মানুষ হয়ে বলতে লজ্জা লাগার কথা, তবে আমার পেটে প্রজাপতি দৌড়াচ্ছিলো। ভয়ের প্রজাপতি। কেউ যদি…..
তোমার আমার নিশ্বাসের মাঝের সাড়ে চার ইঞ্চি জায়গায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলো সেই কুয়াশা, যে কুয়াশায় ভয় আছে।
সেই সোনালী ঘাসের রাজার রানীর দালান ঘেরা জায়গাটায় যাওয়ার জন্য সবার চোখ অন্ধকারে বন্দি রেখে আমরা পালিয়ে যে বাসটায় উঠেছিলাম, তার পোড়া পেট্রোলের গন্ধ নাকে বসবাস করছিলো ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ না তুমি তোমার কালো শালটা আমার নাকে চেপে ধরলে, যাতে কিনা লেগেছিলো ‘Vitalis Brand’ এর perfume. বিশ্বাস করো আর নাই করো, যে খামে ভরে এই চিঠিটা রেখে দিবো সেই খাম আমি চাপা দিয়ে রেখেছি সেই perfume এর গোলাপি বোতল দিয়েই যার মুখটা ভেঙে গিয়েছিলো তোমার হাত থেকে পড়ে।
আমার হাত ছিলো তোমার সপ্তম কশেরুকার উপরেই, আর তোমার হাত ছিলো আমার এক গাদা চিন্তার চাপ বয়ে নিয়ে বেড়ানো কাঁধের উপর। আত্মা দুটোর মাঝের সাড়ে চার ইঞ্চি জায়গায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলো সেই কুয়াশা, যে কুয়াশায় ভয় আছে।
তোমার বাম চোখের কোণার আর ঠোঁটের ঠিক উপরের তিলটা আমাকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছিলো। চিন্তা এইটা ছিলোনা যে তাদেরকে আমি ছুঁয়ে দেখবো কি না, চিন্তা এইটা ছিলো যে আমি ভাবছিলাম এই তিলগুলো দেখার সুযোগ যদি আর না আসে কখনও। এই ভোরের সময়ে এই দিকটায় কেউ আসেনি তখন দু-একটা চড়ুই পাখি ছাড়া। তুমি তোমার দুটো পা আমার দুটো পায়ের উপর রেখেছিলে, আর কানকে আমার ঠোঁট ভেবে বলেছিলে “কথা বলা কি মানা?”। উত্তর আমি ঠোঁট দিয়েই দিয়েছিলাম এই বলে,”তুমি সখী সাথে থেকো।”
তবে তোমার কান আর আমার ঠোঁটের মাঝের সাড়ে চার ইঞ্চি জায়গায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলো সেই কুয়াশা, যে কুয়াশায় ভয় আছে। হারানোর ভয়।
তুমি হয়তো কথা শুনতে পাওনি সেদিন। তাইতো আমার পাশের বালিশ, পাশের চেয়ার, ক্লান্ত কাঁধটা, শক্ত হাতটা, লেটার বক্স আর রান্নাঘরটা, টেলিফোন কল, পানসে সকাল, চুলায় কুকারের শেষ শিসটা এখনো শুণ্য হয়ে আছে। শুণ্য হয়েই শুরু করলো আরেকটা দিন। আর আমি শেষ করলাম আরেকটা চিঠি।
একটা খবর দিয়ে শেষ করি। আমি সেই রাণীর দালানে আর যাইনি। দালানটা বাকি দেবে গিয়েছে কুয়াশার তলে। যে কুয়াশায় ভয় ছিলো।
ইতি,
ভীতু আমি।