বাজলো কলিংবেল

বাজলো কলিংবেল

Rajiul Huda Dipto is a professional screenplay writer and working for years in the Bangladeshi TV industry. Besides that, he introduces himself as a photographer, whose photographs have been featured in various magazines and exhibitions all around the world. Not regularly, but he publishes his works in national dailies as well. Currently, he is working as a community writer in BuzzFeed and a contributor in Getty Images.

গোসল থেকে বের হয়ে শাড়ির আঁচল ঠিক করছে শায়িরা। শাড়ির আঁচল ঠিক করা খুব সহজ কোনো বিষয় না। ভাঁজের দিকে বিশেষ মনোযোগ দিতে হয়। আঁচলের ভাঁজ একের সাথে আরেক লেগে গেলেই সমস্যা। একদম টানটান আর আলগা হওয়া লাগে। ছোটবেলায় খেলার ছলে মায়ের শাড়ির আঁচল ঠিক করতে গিয়ে পুরো বিষয়টি আয়ত্ব করে ফেলেছে সে। মাথায় বেণী করে কাকভেজা চুলে আকাশী তয়লা জড়িয়ে রেখেছে, মায়ের মতো। কোমরের নিচ অবধি চলে গিয়েছে চুল শৃঙ্খলার সাথে। আঁচল ঠিক করতে করতেই নাক শিঁটকোয় শায়িরা। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির সময় আশেপাশের ময়লার গন্ধ জীবন্ত হয়ে ওঠে। তীব্রতার সাথে নাকে ঢোকে।

ইলিশ মাছের আঁশটে গন্ধ তার নাকে ঢুকছে, খোলা জানালাটা দিয়ে ভেতরে আসছে গন্ধটা। সে তার আঁচল ঠিক করায় মন দেয়। সাথে এইটা ভেবে বিরক্তি হয় যে, কাজের বুয়া আজ যাবার সময় আঁশটে বাড়ির পাশেই ফেলে এসেছে। খুব বিরক্তকর।

কলিংবেলটা বেজে ওঠে। খুব তাড়াহুড়োয় আছে এমন কেউ বেলটা বাজায়নি। বেশ কিছুক্ষণ চেপে রেখে তারপর সুইচ থেকে আঙুল সরানো হয়েছে। এই সময় আবার কে এলো? বুয়া কি কালকের ভাতগুলো নিয়ে যেতে ভুলে গেলো? কিন্তু, সে তো এতো ধীরস্থিরভাবে বেল চাপেনা। আর, একসাথে গুনে গুনে চারবার টেপে। তাহলে কি ফয়সাল? সে এই সময় কেনো আসতে যাবে? সেও তো চটজলদি অবস্থাতে বেল চাপে। এতো ধৈর্য তার নেই। গুনে গুনে দুই বার। কিন্তু, এতো খুব ধীরে চেপেছে, তাও আবার একবারই চেপে আর কিছু বলছে না। পাড়ার বদমাস বাপ্পি কি বেল চিপে পালিয়ে গেলো? তাও আবার এই বৃষ্টিতে?

শায়িরা এতোকিছু ভাবতে ভাবতে দরজা পর্যন্ত যায়। মাথাতে বেণী করা তয়লাটা পেছনে ঝুলছিলো। সে সামনে করে নেয়। গালের পানির ফোঁটাগুলো হাত দিয়ে মুছে ফেলে। তারপর দরজা খোলে। আধুনিক যুগের দরজা নয়। উপরে সিঁকি দেয়া দরজা। সিঁকিটা নিচে পড়ে গেলে ‘ঠক’ করে একটা শব্দ হয়। সামনে রাহাত দাঁড়ানো। পুরোদস্তুর ফরমাল গেটআপ পরানো। চুলগুলো দেখলেই বোঝা যায় সিঁথি করা ছিলো। বৃষ্টি আর দক্ষিণ কোণের বাতাস এলোমেলো করে ফেলেছে অনেকটাই। চোখে চশমা আগের মতোই। চেকচেক নীল শার্ট, ব্যাংকাররা যেমন পরে। শায়িরা দু’হাতে দরজার দু’টি দিক ধরে দাঁড়িয়ে আছে। বাইরে প্রচন্ড শীতল অসভ্য বাতাস। খুব ঠান্ডা লাগা শুরু করেছে তার। তবে, শাড়ির আঁচলের কোনো সমস্যা হচ্ছে না। বিশ্রিভাবে পেট থেকে শাড়ির কিছু অংশও সরে যাচ্ছে না। সত্যিই শাড়ি পরাটা বেশ ভালো করেই আয়ত্ব করতে পেরেছে শায়িরা। তবে, শায়িরার পেট গুড়গুড় করছে। হৃদকম্পন অনেকটা বেড়ে গিয়েছে বললে, খুব তথাকথিত বিষয় হয়ে যাবে। তার হৃদকম্পন শিথিল হয়ে গেছে। ভ্রু কপালের ভাঁজের মতো কুঁচকে গেছে।

“তোর বাসা?”, অপ্রস্তুতি আর উৎকন্ঠা জড়িত কন্ঠে বলে ওঠে রাহাত। “হ্যাঁ”, বলার সাথে সাথেই শায়িরার ঠোঁটের উপরের তিলটা কেঁপে ওঠে। রাহাত বলে, “কেমন আছিস?” শায়িরা বলে, “তুই হঠাৎ এইখানে?” রাহাত হাতের কাগজের ফাইল দেখিয়ে বলে, “আসলে একটা ডকুমেন্ট দেয়ার ছিলো ফয়সাল নামের এক ভদ্রলোককে।” তারপর সে ফাইলের উপর লেখা ঠিকানাটা পড়ে বলে, “এইখানে ঠিকানা তো এইটাই দেয়া আছে।”

“নাম-ঠিকানা ঠিকই আছে”, বলে শায়িরা। বাইরে দমকা হাওয়া আরো বেড়ে যায়। শুধু রাহাতেরই না, দরজাটা খুলে দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে শায়িরারও। রাহাত ফাইলটা শায়িরার হাতে দেয়। শায়িরা ফাইলটা হাতে না নিয়ে বলে, ” এখনতো যেতে পারবি না। ভেতরে আই।” রাহাত ভেতরে যায়। শায়িরা দরজা লাগিয়ে দেয়।

“বস,” বলে শায়িরা।

“থ্যাংক ইউ,” বলে সিংগেল সোফাটায় গিয়ে বসে রাহাত। শায়িরা এতোক্ষণে নিজেকে অনেকটাই সামলে নিয়েছে। টানা পাঁচ বছর বাদে রাহাতের সাথে দেখা। অনেক কিছু পাল্টে গেছে এতোগুলো দিনে। পাল্টেছে দু’জনেরই উপলব্ধি। বৈজ্ঞানিক এক গবেষণার ফল বলে, টানা ছয় মাস আপনার অতি আপনজনকে না দেখে থাকলে আবছা হয়ে তার চেহারা আপনার মাথা থেকে চলে যায়। এক বছরে গিয়ে তা আরো প্রকট হয় আর ধীরে ধীরে এটি তীব্রতর হয়। পাঁচ বছর, অনেক সময়। চেহারা ভুলে গিয়েও, কয়েক সেকেন্ডের দেখায় আবার পুরোটা মনে পরে গেছে দু’জনেরই।

শায়িরা বলে, “ফয়সাল আমার হাজবেন্ড।” রাহাত বলে, “ও।”

– “ফাইলটা কিসের?”

– “উনি তো লোনের জন্য এপ্লাই করেছিলেন বেশ কিছুদিন আগে।”

শায়িরা ফাইলটা হাতে নিয়ে দু’একটা পাতা উল্টিয়ে বলে, “হয়ে গেছে?” রাহাত বলে, “না, কিছু কারেকশন আছে। সেটা উনাকেই করতে হবে। তাই, ফাইলটা উনাকে দিতে আসা।”

– “তুই তাহলে লোন ডিপার্টমেন্টে আছিস?”

– “না। আসলে ফাইলটা আমার দিতে আসবার কথাই নয়। আমার জুনিয়র আবু তার দেয়ার কথা। আমিতো এই ব্রাঞ্চেই কাজ করিনা। চট্টগ্রামে আছি। আজ একটা কাজে এসেছিলাম। আবু আমার খুব কাছের। সে প্রচন্ড ব্যস্ত ছিলো, ভাবলাম আমার যাওয়ার পথেই পড়বে যেহেতু ওর কাজটা কমিয়ে দিই।”

– “পরোপকারিতা আজও যায়নি তাহলে?”

– “আজ পরোপকারিতার জন্যই কিন্তু তোর সাথে দেখা হয়ে গেলো। পাঁচ বছর পর।”

– “তুই না বলেছিলি, কখনো দেখা করবিনা?”

– “হুম। তুইও কি চেয়েছিলি?”

– “হয়তো। চা খাবি?”

– “না, আমার এক ঘন্টা বাদেই ফ্লাইট। চট্টগ্রাম গিয়েই লাঞ্চ করবো।”

– “এতো বৃষ্টিতে যাবি কিভাবে?”

– “গাড়ি আছেতো।”

– “এইখানেই লাঞ্চটা করে যা।”

– “এর আগে যতবারই তোর বাসায় গিয়েছি, আমার কিন্তু লাঞ্চটা করা হয়নি।”

– “কিন্তু প্রতিবারই তুই আসলে ফ্রিজে পায়েস থাকতো। বস নিয়ে আসি।”

রাহাত বারণ করতে যাবে। শুনলোনা শায়িরা। পিঠ দেখিয়ে ডাইনিং এর দিকে চলে গেলো সে। ফাইলটা হাত থেকে টেবিলে রেখে চারপাশে তাকালো রাহাত। খুব যত্নের সাথে পুরোনো বাড়িটাকে নতুন করে সাজানো হয়েছে। দেয়ালে বেশ বড় একটা টিভি, অনেকগুলো সোফা। ডাইনিং পাশেই। রান্নাঘরটা দেখা যায়। সোজা তাকালে হয়তো শোবার ঘর দেখা যাচ্ছে। হাতের বামে মেইন দরজা পার করে আরেকটি ঘর মনে হচ্ছে। রান্নাঘরের পাশেই কি বারান্দা? যেমনটা শায়িরা চেয়েছিলো। মনে প্রশ্ন জাগে রাহাতের। তবে, শোবার ঘরের উল্টো পাশ দিয়ে একটা সিঁড়ি চলে গেছে উপরের দিকে। সেটা কি উপর তলার সিঁড়ি না কি ছাদে যাবার? ঠিক শায়িরা যেমনটা চেয়েছিলো।

শায়িরা পায়েস নিয়ে এসেছে। সাথে ফালুদা আর দু’টো মাছ ভাজা। রাহাত একটু হেসে বলে, “মাছা ভাজা?” শায়িরা বলে, “হুম। তোর কত প্রিয়। আর দেখ, কাকতালীয়ভাবে আজকেই ভাজলাম।”

রাহাত বলে, “পায়েস আর ফালুদা কি তোর বানানো?” শায়িরা বলে, “হ্যাঁ।” পায়েসটা মুখে দিয়ে রাহাত বলে, “একদম তোর মায়ের মতো হয়েছে। শ্বশুর বাড়ি পাঠানোর আগে নিশ্চয় হাতে কলমে শিখিয়েছেন উনি।” এরপর ফালুদা মুখে দিয়ে রাহাত বলে, “মিষ্টি বেশ কমিয়ে দিয়েছিস। ফালুদা বানানো ভুলে গেছিস নাকি?” শায়িরা বলে, “না, আসলে ফয়সাল বেশী মিষ্টি পছন্দ করে না। তাই, একটু ধরন পাল্টাতে হয়েছে।” “আচ্ছা,” বলে রাহাত।

শায়িরা মাথার তয়লাটা খুলে এসেছে। মেয়েদের চুল ভিজে থাকলে কুঁকড়ে থাকে। সেরকমই হয়ে আছে শায়িরার লাজুক চুল। ডান চোখের ঠিক পাশটা দিয়ে বেয়ে গেছে চুলের দেয়াল। আরো উজ্জ্বল লাগছে শায়িরাকে। আরো পরিপূর্ণ। দেখলেই বোঝা যায়, ভালো আছে শায়িরা। সবই আছে, পেয়েছে সবকিছুই। কিন্তু, কোনো মানুষের জীবনতো সম্পূর্ণভাবে পরিপূর্ণ হয়না। না পাওয়ার মধ্যে রাহাতকে পাওয়াটাই বাকি থেকে গেছে হয়তো।

“কেমন হয়েছে মাছ ভাজাটা?” জিজ্ঞেস করে শায়িরা। রাহাত বলে, “দুর্দান্ত। হাল্কা আঁচে বেশ কড়া করে ভাঁজা।” শায়িরা বলে, “যাক, সন্তুষ্ট করা গেছে দেখছি তোকে তাহলে।”

– “একটা প্রশ্ন করি।”

– “কর।”

– “তোর রান্নাঘরের পাশে কি বারান্দা?”

– “কিভাবে বুঝলি?”

– “তুই সবসময় চায়তি এমনটা হোক, তাই ভাবলাম পেয়েছিস কি না।”

– “হুম, পেয়েছি।”

– “সিঁড়িটা বেয়ে কি ছাদে যাওয়া যায়?”

– “না, উপরে বাবা-মা থাকতেন। দুই বছর হলো উনারা মারা গেছে।”

– “তাহলে এই পাওয়াটা পূরণ হয়নি।”

– “সব পাওয়া কি পূরণ হয়?”

– “নাহ।”

– “তবে উপর তলাটা পার করেই ছাদ।”

– “কতগুলো গাছ আছে ছাদে?”

– “অনেকগুলো গাছ। বেশ কয়েকদিন থেকে যত্ন করাই হচ্ছিলোনা। বৃষ্টিটা হয়ে ভালো হয়েছে।”

– “হুম।”

– “তোর কথা বল। বিয়ে কবে করলি?”

– “কিভাবে জানলি বিয়ে করেছি”

– “করসনি?”

– “হুম, করেছি।”

– “কি নাম?”

– “স্নিগ্ধা।”

– “বাহ, কি করে।”

– “একটা নিউজপেপারে আছে৷ ঢাকায়।”

– “দুইজন আলাদা থাকিস? ছেলে-পুলে হবেনা তো।”

– “হাহাহাহাহাহা, যাওয়া আসার মাঝেই থাকি। তোরা তো একসাথেই থাকিস। বাচ্চা নিসনি।”

– “নিবো তো। আগে তুই নে।”

হাসতে শুরু করে রাহাত। এরমধ্যে মধ্যস্থতা বৃষ্টি কমে এসেছে। রাহাত বলে, “আমাকে যেতে হবে। ফ্লাইটের সময় হয়ে আসছে প্রায়।” শায়িরা বলে, “তোর না এরোফোবিয়া ছিলো? বিমানে চড়তে ভয় পেতি।” হাল্কা হেসে রাহাত বলে, “ভয় তো তোকে হারানোরও পেতাম। হারাতে তো হলোই।” শায়িরা বলে উঠে, “এতোদিন বাদে দেখা হলো। এখনো অভিমান আমার উপর।”

– “অভিমানটা হয়তো সময়ের উপর।”

– “আমাদের কি কোনো দোষ নেই?”

– “ঘুণাক্ষরেও যার কথা ভাবিনি, তাকে হঠাৎ করে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। সেও বেসে ফেলেছিলো। দোষটা কোথায়?”

– “জানি না।”

– “আমি আজ এসেছিলাম, তোর জামাইকে বলবি?”

– “কেনো বলবোনা?”

– “ওকি আমাদের ব্যাপারটা জানে?”

– “তোর বউ জানে?”

– “হুম, জানে।”

– “একটু বস। চা বসিয়েছি।”

– “আজ আর খাবো না। দেরী হয়ে যাচ্ছে খুব।”

– “আচ্ছা। আমি আসছি।”

শায়িরা প্লেটগুলো নিয়ে ভেতরে চলে গিয়ে চুলো বন্ধ করে বেরিয়ে আসে। রাহাত উঠে দাঁড়িয়েছে আগেই। দরজার কাছে দাঁড়ানো আছে। শায়িরা গেইট খুলে দেয়। রাহাত বলে, “তোর মনে আছে আমাদের দেখা হলেই আমার সবচাইতে অপছন্দের বিষয় কি ছিলো।” শায়িরা বলে, “বিদায় জানানো।” রাহাত বেরিয়ে বলে, “আজও তাই। চলি।”

একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে গেটের কাছেই। রাহাত সেটায় উঠে পড়েছে। শায়িরা বলে, “ভালো থাকিস। আল্লাহ হাফেজ।” খুব কষ্টে গালের কোণে এক চিলতে হাসি দেখা যায় রাহাতের। গাড়ি চলতে শুরু করে৷ প্রচন্ড ঠান্ডা। গাড়ির মধ্যে এসি চলছে। দাঁতে দাঁত চিপে বসে থাকে রাহাত। চোখে চোখ চেপে বসে থাকতে পারেনা সে। একটু ভিজে আসে কোণটা।

শায়িরা কেবল দরজাটা লাগিয়ে ভেতরে গেছে। টেবিলের উপর রাহাতের রেখে যাওয়া ফাইলটা পড়ে আছে৷ সে ফাইলটা তুলে নিয়ে তার শোবার ঘরে যায়। একবার খুলেও দেখে না। বিছানার উপর ফেলে রাখে সেটা। এরপর ফাইল কেবিনেটের প্রথম ড্রয়ারটা খুলে একটা ফাইল বের করে। বিছানায় পরে থাকা ফাইলটার কাছে এসে রাখে।

রাহাতের দেয়া ফাইলটার প্রথম পাতা খোলে শায়িরা। ব্যাংকের নাম যে জায়গাটায় লেখা, তার পাশে একটা কালো কালির টান। হালকা আঁচড় লাগলে যেমনটা দেখায় সেরকম। এবার ফাইল কেবিনেট থেকে বের করা ফাইলটার প্রথম পাতা খোলে শায়িরা। এইখানেও ব্যাংকের বড় করে লেখা নামটার পাশে একটা কালির দাগ, একইরকম দাগ। দু’টো ফাইলেরই পাতা ওল্টাতে থাকে শায়িরা। কাগজের মার্জিন থেকে শুরু করে লেখা সবকটি ফিগার, সবকিছুই হুবুহু একই। মুচকি হেসে ওঠে শায়িরা।

কিছুদিন আগে লোনের এই কাগজটা ব্যাংক থেকেই বাসায় দিয়ে গেছে। শায়িরা নিজেই রিসিভ করেছে৷ আজ যখন সে রাহাতের কাছ থেকে ফাইলটা পায়, সে জানতো এইটা সেই ফাইল। হুবুহু সেটাই। সে জানতো, রাহাত কোনো ফাইল দিতে আসেনি। শুধু এসেছিলো তাকে দেখতে। রাহাতের থেকে যাওয়া পুরো সময়টা জুড়ে শায়িরা জানতো এই সবকিছুই। তবুও, সে কিছু বলেনি। কেনো বলবে? তারও তো তাকে দেখতে ইচ্ছা করছিলো৷ কেনো বলবে? সেও তো চেয়েছিলো রাহাত আসুক তার পছন্দের নীল রঙের চেকচেক শার্ট পরে। কেনো বলতে যাবে সে? শায়িরা তো নিজেই চেয়েছিলো দু’জন মিলে বৃষ্টিতে ভিজতে। হোক না সেটা দরজায় দাঁড়িয়ে ঠিক দু’জন অচেনার মতো।

শহরটা আবার ভিজে একাকার। গলির মোড়ে রাস্তাটায় পানি জমেছে, বৃষ্টি কমেছে। বাইরে লোকজন বেরিয়ে এসেছে। আবছা হওয়া জানালার কাঁচে গুটিগুটি দানা বেঁধেছে বৃষ্টির পানির দাগ। বিকেল বেলাটা বুড়িয়ে গেলো কেমন করে। বয়স বেড়ে সন্ধ্যা হয়ে এলো আবার। টেবিলের খাবারগুলো জমে ঠান্ডা। ডাল তার স্বাদ হারিয়েছে ঠান্ডা হয়েই। ভাতগুলো ঠিক মনের মতোই শুভ্র শ্বেত। চেয়ারগুলো ফাঁকা পড়ে আছে। ছাদের গাছগুলো এতোটা ভিজতে চায়নি হয়তো। রান্নাঘরের বারান্দাতে পুরোনো যত চেয়ার-টেবিলে ঘুণ পোকারাও ভিজে একাকার। দম নিচ্ছে একটু করে। ডিসওয়াশারে একাকী প্লেট পড়ে আছে নিজের মতোই। চা ফুটলো ঠিকই, তবে ঢালা হলোনা প্রিয় কাপটায়।শাড়ির আঁচল জীবনের মতোই নিয়ম মাফিক রয়ে গিয়েছে। সিংগেল সোফাটার কুশন এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে। চুলগুলো যেই না শুকাতে চায়লো, বেজে উঠলো কলিংবেল। আবারো দরজা খোলার আশায়, আবার বেজে উঠলো কলিংবেল। দরজা খুলেই যাকে প্রতিবার দেখতে চাই, সে আসবে বলে হয়তো বাজলো একটি কলিংবেল।