একদিন বৃষ্টিতে বিকেলে

একদিন বৃষ্টিতে বিকেলে

Rajiul Huda Dipto is a professional screenplay writer and working for years in the Bangladeshi TV industry. Besides that, he introduces himself as a photographer, whose photographs have been featured in various magazines and exhibitions all around the world. Not regularly, but he publishes his works in national dailies as well. Currently, he is working as a community writer in BuzzFeed and a contributor in Getty Images.

“দিনের বেলা রোদের মধ্যে বৃষ্টি হচ্ছে। তুমি তোমার কাজিন আর মামা-মামির সাথে এই হোয়াইট প্যালেসের ছাদে বৃষ্টিতে ভিজছো। এইটা তোমার দাদা বাড়ী। পাশেই দেয়াল ঘেষে লাগানো তোমার বাবার বাসা। হোয়াইট প্যালেসের তুলনায় ছোট। বৃষ্টির মধ্যে, নায়ক তার ছোট ভাই আর কাজিন নিয়ে তোমার বাড়ির সামনের মাঠটা পেড়িয়ে যে চায়ের স্টল আছে সেখানে এসেছে। প্রতি সপ্তাহের সোমবার এই ছোট জায়গায় হাট বসে রাতের বেলা। গত সোমবার রাতে সে একবার এসেছিলো এইখানে। ফ্ল্যাশব্যাকে সেই সিনটা যাবে। নায়কের গায়ে চাদর। কোনো ভারিক্কি চাদর নয়, বরং একটা ইয়ং ছেলের যেমন ছোট আর পাতলা চাদর পড়া উচিত তেমন একটা চাদর থাকবে তার গায়ে। দিনের মধ্যে, রোদের মধ্যে যেহেতু বৃষ্টি সেহুতু চারিদিক চমকাচ্ছে। গাছের পাতাগুলো ক্যামেরায় আলাদা ইফেক্ট আনছে। নায়ক একবার চাদর ঠিক করে, তোমাদের হোয়াইট প্যালেসটার দিকে তাকিয়ে চায়ের দোকানে ঢুকতে যাবে কিন্তু সে ঢুকবে না। তখনই, সে তোমাদের ছাদে আবিষ্কার করবে। তার কাজিন আর ছোট ভাই দোকানে ঢোকার পর চায়ের অর্ডার দিয়ে বসেছে। বৃষ্টির বেগ বাড়বে না, একই রকম থাকবে। তোমাকে ভিজেই যেতে হবে। এই ভেজা, অশালীন লাল শাড়ি পড়ে ভেজা নয়। তোমার অঙ্গভঙ্গিও মার্জিত হবে। তোমার সামনে তোমার ছোট কাজিনরা আর মামা-মামী আছেন। নায়ক চায়বে, তোমাদের সামনে না আসতে। তোমার পরিবার নায়ককে চেনে এবং অন্য সম্পর্কের কারণে আদর করে। সুতরাং, দেখলেই তাকে বাসায় ডাকবে। আর, সে তোমার সামনে যেতে চায়না। কি কারণে, যেতে চায়না সেটা নিশ্চয়ই স্ক্রিপ্ট পড়ে জেনে গিয়েছো। এখন, সে লুকিয়ে ছাদের দিকে তাকানো। হুট করে, তোমার মামা-মামী দেখে ফেলে তাকে উপরে ডাকে। একই সাথে তোমার কাজিনরা এলং উইথ তুমি, তাকে হাত নেড়ে ডাকতে থাকো। মনে রেখো, ক্যামেরা ছাদের উপর থাকবেনা নিচে থাকবে। তাই, নায়কের কাজ কম আর তোমার বেশী। দূর থেকে প্রেজেন্স বোঝাতে হবে তোমাকে। নায়ক ইতোমধ্যে বিচলিত হয়ে গিয়েছে। সে ডাকে সাড়া দিতে চায়না। তুমি পৌশাচিক আনন্দ পাচ্ছো সবাই তাকে ডাকছে দেখে। কারণ, সে তোমার সাথে দেখা করতে না চায়লেও তুমি তার সাথে দেখা করতে চাও। তার সাথে এতো বছর পরে দেখা হওয়ার পর, তুমি্ স্বদিচ্ছায় এমন কষ্টটা উপভোগ করতে চাও”।

পরিচালক তার বর্ণনা শেষে এইবার থামেন। উনার সামনে বসে আছেন বাংলার এই সময়ের চাহিদসম্পন্ন নায়িকা শর্মিলা। উনার চেহারা রুরাল ক্যারেক্টারের জন্য আদর্শ। টানা চোখ ইদানিংকালে প্রায় সমস্ত নায়িকার থাকে, উনার আছে ভরাট গাল যা অন্য নায়িকাদের খুব একটা নেই। চুল ছাড়লে যেমন কিশোরী লাগে, অমনি চশমা পড়লে গ্রামের প্রাইমারী স্কুল টিচারের মতো লাগে। উত্তম বাবুর সাথে ‘নায়ক’ সিনেমায় যেমনটা লেগেছে। সেই ছবির পরিচালক, আর এই ছবির পরিচালক একজনই। উনার নাম লিখতে গিয়েও হাত কাঁপে। সত্যজিৎ রায়। ডাক নাম ‘মানিক’। প্রথমে তাঁর নাম রাখা হয়, ‘প্রসাদ’। এই কথা প্রচলিত আছে যে, রবীন্দ্রনাথকে উনার নাম রাখতে বলা হলে উনি তাঁর নাম রাখেন ‘সহজ কুমার। কারণ, সত্যজিৎ রায়ের কাকাতো ভাইয়ের নাম ছিলো ‘সরল কুমার’। রবি ঠাকুর ঠাট্টা করেই এমন নাম রাখেন। পরবর্তীতে, সুকুমার রায় তাঁর নাম পাল্টে রাখেন সত্যজিৎ রায়। এই প্রথম উনাকে আমি এতো সামনে থেকে দেখছি। উনার চেহারা প্রচন্ড পরিমাণে রাগী আর আওয়াজ উনার শক্ত হাতটার মতই ভারী। উনি নায়িকাকে দৃশ্য বোঝানো শেষ করলেন। আনন্দ পত্রিকার চিফ এডিটর আমার সদ্য পাওয়া ডেস্কে ফাইল পাঠিয়ে বললেন, “যা, জিলে আপনি জিন্দেগি”। আমি সাথে সাথে উনার রুমে গিয়ে বললাম, “এইটা ‘উপভোগ’নাকি ‘উপযোগ’? আমার চাকরীটা কি খাবেন? আমি সত্যজিৎ রায়ের ইন্টারভিউ নিতে পারবোনা”। চিফ এডিটর সদামোহন বললেন, “শ্যুটিং শেষ আর পরের ছবির স্ক্রিপ্ট লেখার মাঝখানের যেসময়টা আছে উনি আমাদের সেই সময়টা দিবেন আজ। উনার ইন্টারভিউ মানে, আমাদের লাভ, তোমার খ্যাতি আর বেতন বাড়ার চান্স”। আমি কিছু না বলে বেরিয়ে আসবো, সদামোহন তখন বলে উঠলেন, “উনার সাথে দেখা করে ফেরার সময় রায়ের বাড়ির চায়ের অফার দিবেন উনি। ভুলেও যদি মিস করো, তাহলে বাসায় এসে বিষ খেও”। কোনো উপায় না দেখে আমি এক ঘন্টার মধ্যে কিছু প্রশ্ন সাজিয়ে সোজা শ্যুটিং সেটে চলে আসলাম।

সিন শুনে শর্মিলা বললেন, “মানিকদা, আমার ডায়ালগ কি এই সিনে?” সত্যজিৎ বললেন, “এক্সপ্রেশন ইজ ইওর ডায়ালগ।” শর্মীলা এইবার হেসে বললেন, “তাহলে আমাকে এতো বর্ণনা দিলেন কেনো?” বৃষ্টির বেগ, নায়কের চাদর, চায়ের দোকান, বাড়ির বর্ণনা, এইসব শুনে আমি কি করবো?” উনি বললেন, “একটি দৃশ্য যদি দৃশ্য না শুনে, তাহলে সেই দৃশ্য দৃশ্যমান হবে কি করে? এই দৃশ্যের তুমিই দৃশ্য।“ এই বলে, সত্যজিৎ রায় উঠে গেলেন। আমি উনার ঠিক পেছনের দিকে খাতা কলম রেডী করে বসা। যা বলছেন, তাই টুকছি। ইতোমধ্যে আমি আমার নিউজের হেডলাইন পেয়ে গেছি হয়তোবা। সেটি হচ্ছে, “এই দৃশ্যের তুমিই দৃশ্য”। লিখে রাখলাম। উনি উঠে রুম থেকে বের হবেন, এমন সময় উনার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন ক্যামেরাম্যান রবিলাল স্যান্নাল। উনার থেকে ম্যানেজ করে, সময় বের করা হয়েছে। বলা যেতে পারে, উনাকেই আমি এইখানে চিনি। চিনি থেকে মনে পড়লো, কম চিনির এক কাপ চা সেটে আসার পরেই আমাকে দেয়া হয়েছিল। সত্যজিৎ রায়ের সেটে নাকি, কম চিনির চায়ের বেশ প্রচলন আছে। উনি মনে করেন, চিনি বেশী খেলে নাকি ঘুম বেশী আসে। সেটা চায়ে দিয়ে খাওয়া হোক, কিংবা বিষে।

সত্যজিৎ রায় উঠে দাঁড়াতেই রবিলাল বাবু উনাকে আমাকে দেখিয়ে কিছু একটা বললেন। উনি আমার দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে হাঁটা দিলেন। রবিলাল বাবু, আমাকে উনার সাথে ডাকলেন এবং সত্যজিৎ রায়ের পেছনে দেখলাম উনিও হাঁটা দিলেন। আমি কাগজপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে ছিলাম, হেড লাইনের জন্য নীল, কারেকশনের জন্য লাল আর লেখার জন্য কালো কালির পেন। পেন্সিল আছে, তবে কোনো কাজের নয়। সাথে করে নিয়ে এসেছিলাম, নাহলে সে একা একা আমার অফিসের ডেস্কে বসে থেকে পরচর্চা শিখতো। আমি উঠতেই সব কাগজপত্র মেঝেতে পড়ে গেলো। ভাগ্য প্রসন্ন, এতোক্ষণে শর্মিলা এই ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছেন। আমি সব কুড়িয়ে তাদের পেছনে হাঁটা দিলাম। বাইরে, বিশাল বড় সেট। এতোদিনে, সত্যজিৎ রায় বেশী টাকার সিনেমা বানাতে শুরু করেছেন। উনিই একজন ইন্ডাষ্ট্রি। আসলেও, তাই। সত্যজিৎ রায় রবিলাল বাবুকে সাথে নিয়ে, সেট নিয়ে আলোচনা করছেন। বাইরে, ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে তাই কৃত্রিম বৃষ্টির দরকার নেই এই সিনের জন্য। আমি উনাদের খুব কাছেই দাঁড়িয়ে আছি। উনি রবিলাল বাবুকে বললেন, “ইজ ইট পসিবল মাঠের ঠিক মিডিল থেকে এই ক্যামেরা এগিয়ে আসবে নায়কের দিকে দুই সেকেন্ড পার ফুট স্পিডে, যখন কিনা সে তাঁর গায়ের চাদরটা ঠিক করবে?” রবিলাল বাবু বললেন, আমাদের ট্রলি না এতো বড় আছে না এতো বড় চাকা আছে মানিক দা”। সত্যজিৎ একটু ভেবে বললেন, “বাজেটের বাইরে যাবে না? এক কাজ করো, উপর থেকে মানে নায়কের ঠিক উপর থেকে শট নিবে। ক্যামেরা নামছে নামছে আর নামলো আর নায়ক চাদর তাঁর গলাতে জড়ালো। মনে রাখবে, তাঁর পা আসা যাবেনা, শুধু কোমর”। রবিলাল বাবু বললেন, “ঠিক আছে। কিন্তু, আগের শটটা নিতে পারলে দারুণ হতো। সত্যজিৎ বললেন, “কি করবে? নেসেসিটি ইজ দ্যা প্রায়রিটি।“ আমি আরও একটি হেডলাইন পেয়ে গেলাম। “নেসেসিটি ইজ দ্যা প্রায়রিটি – সত্যজিৎ রায়”।

এবার দেখলাম, উনি একটু এগিয়ে গিয়ে এডিটিং রুমে গেলেন। শ্যুটিং সেটেই এডিটিং প্যানেল। সত্যজিৎ রায় শ্যুটিং শেষেই এডিটিং এ বসেন, আমার এইটা জানা ছিলো। কিন্তু, এই প্যানেল যে উনার সেটেই মুভি সেটে বসানো রাখবেন সেটা ভাবিনি। আমিও উনার পেছন পেছন ভেতরে ঢুকলাম। একটা অন্ধকার রুম। একটা স্ক্রিন। তখনও ডিজিটাল এডিটিং মেশিন টলিউডে আসেনি। বোম্বেতে এসেছে, কিন্তু সবাই এফোর্ড করতে পারেনা। তাই, ম্যানুয়াল। প্রিন্ট ধরে কাটতে হয়। আমি দরজার কাছে বেশী অন্ধকার জায়গা দেখে এক পাশে দাঁড়িয়ে গেলাম। সত্যজিৎ রায়, একটা চেয়ারে বসে কাটা শুরু করলেন। স্ক্রিনে দেখলাম, “চিড়িয়াখানা” মুভির দৃশ্য। শরবিন্দু বন্দোপাধ্যায় এর বোম্বকেশ বক্সী। উত্তম কুমার সিগার থেকে ধোঁয়া উড়াচ্ছেন। তাঁর বন্ধু আবছা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। একজন লোক আছে রুমে, উনি কেসটা নিয়ে এসেছেন। উত্তম কুমার, সিগারে একটা টান দিচ্ছেন আর লোকটা উনার দিকে তাকিয়ে কথা বলে যাচ্ছেন। উনি সিগার টানার পর ধোঁয়া ছাড়বেন ঠিক এই মূহুর্তে সত্যজিৎ রায় “কাট” বলে ফিতা ধরে কেটে দিলেন। ঠিক পরের সিনটা দিলেন, ধোয়াটা উত্তম কুমার লোকটার দিকে তাকিয়ে হাওয়াতে উড়িয়ে দিলেন। এন্ড অফ এ সিন। সত্যজিৎ রায়, এইবার সিগারেট ধরালেন একটা। পাশে বসে থাকা দুইজন লোকও সিগারেট ধরালেন। অন্ধকার রুমে, স্ক্রিন থেকে উড়ে আসা আলোতে দেখতে পেলাম সত্যজিৎ রায়ের সিগারেট থেকে বেরিয়ে আসা ধোঁয়া সবচেয়ে বেশী উপরে উড়ছে। আমার দৃষ্টিভ্রমও হতে পারে এইটা। একটা চিকন ছোকড়া আমার কাছে এসে মুখের সামনে একটা সিগারেট এগিয়ে দিলো। অন্ধকারে সে আমাকে কিভাবে দেখলো, আমি তাই চিন্তা করছি। আমি বললাম, “আমার অভ্যেস নেই। ধন্যবাদ।“ ছোকড়াটা বললো, “মানিকদা আপনাকে দিতে বললেন, নিন না”। আমি অবাক হয়ে গেলাম, এই অন্ধকারের মধ্যে সত্যজিৎ রায় আমাকে দেখেছেন? আমাকে দেখে, আবার একটা সিগারেটও পাঠিয়েছেন? আমি রিজেক্ট করতে পারলাম না। ছেলেটা একটা দেশলাই এগিয়ে দিলো। আমি মিথ্যে করে বললাম, “লাগবেনা, আছে”। ছেলেটা হেঁটে চলে গেলো। আমি তো সিগারেট খাইনা। কিন্তু, স্বয়ং সত্যজিৎ সিগারেটটি আমার নামে বরাদ্দ করলেন, আমি কিভাবে না নিই। সিগারেটটি পকেটে ঢুকিয়ে রাখলাম। ব্যাচেলর কামরার ছোট কাঠের শোকেসে দাঁড় করানো রাখবো এইটা।

সত্যজিৎ রায় উঠে দাঁড়ালেন। উনি আমার গা ঘেষে বেরিয়ে যাবার সময় বললেন, “আসো”। আমার এখন হিম হয়ে আটকিয়ে থেকে যাওয়া উচিত, হাতের সব কাগজপত্র হাত থেকে পড়ে যাওয়া উচিত আর ব্যাগটা কাঁধ থেকে ঢলে পড়ে যাওয়া উচিত কিন্তু না। আমার এইসবের মধ্যে একটাও হচ্ছে না। আমি উনার পিছু পিছু এগুতে লাগলাম।

উনি সেট থেকে বের হলেন। উনার বাড়ির পাশেই মুভির সেট বসিয়েছেন। রাস্তা পার করে গেলেই, উনার বাসার সদর দরজা। রায় বাড়ি। যখন স্কুলে পড়তাম, সাইকেল চালিয়ে এই জায়গা দিয়ে যেতাম। প্রতিদিন ঠিক সকাল সাতটায় এক গোয়াল দাঁড়িয়ে থাকতো গেটের সামনে। কিছুক্ষণ পর, গেইট খুলে দেওয়া হতো এবং তিনি ভেতরে ঢুকতেন। আমি এক ফাঁক দিয়ে দেখতে চাইতাম এই বাড়ির ভেতরে কি আছে। কিন্তু, ছোট চোখ আর ছোট বয়সে আমার ছোট মন সেই দরজা দিয়ে ঢুকতে পারতো না। আজ, আমি সেই বাড়ির দরজা দিয়ে ঢুকবো। সত্যজিৎ রায়ের সাথে ঢুকবো। একজন গেইট খুললেন, আমরা দুইজন ঢুকলাম। গেইট দিয়ে ঢুকেই, হাতের বামে একটা ঘর। সেখানে উনি গেলেন। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। ভেতর থেকে দুইজন লোক বের হলেন। একটা টেলিফোন বাজার শব্দ। কেউ একজন সেটা তুলেছে। সত্যজিৎ রায়ের গলা। তিনি কাকে যেনো বলছেন, “কে? ঋতু? হ্যাঁ, আমি ভালো আছি। আচ্ছা, বৃষ্টির জন্য সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখতে পারছো না? হুম, বুঝলাম। তো, কিছুদিন পর গিয়ে দেখবে নাহয়। এই সিনেমা, এতো তাড়াতাড়ি সিনেমা হল থেকে নামবে না। ভালো থেকো”। এই বলে, উনি ফোনটা রেখে দিলেন। আমি খবরের আরও একটি হেইডলাইন পেলাম। “আমার সিনেমা তাড়াতাড়ি সিনেমা হল থেকে নামে না।– সত্যজিৎ রায়”।

সত্যজিৎ রায় বেরিয়ে আসলেন। আমাকে বললেন, “চলো, আমার বাসার জাতীয় ইন্টারভিউ কক্ষে তোমাকে এইবার নিয়ে যাই”। ‘বাসার’, ‘জাতীয়’, এইসব শব্দের সাথে খেয় হারিয়ে ফেলছিলাম। আমি উনার সাথে হাঁটা দিলাম। বিশপ লেফরয় রোডের এই বাড়িটায় কামরার সংখ্যা অনেক হবে হয়তোবা। উনি আমাকে দোতলার উনার স্টাডি রুমে নিয়ে গেলেন। এইবার বুঝলাম, এইটাকে জাতীয় ইন্টারভিউ রুম বলার আসল কারণ কি। আমি যতগুলো উনার ছবি দেখেছি পত্রিকায়, প্রায় তাঁর সবগুলোই এই কক্ষে উঠানো। উনি মশকরা করে জাতীয় বলতে এই কক্ষকে কমন হিসেবে বুঝিয়েছেন। এমন মস্তিষ্ক থেকে বেরিয়ে আসা মশকরা বুঝতেও, তেমন এক মস্তিষ্ক লাগে। সত্যজিৎ, জানালার কাছটায় রাখা উনার চেয়ারে গিয়ে বসলেন। আশেপাশে, এতো অগোছালো বই এতো কাগজ। তারপরেও, খুব দারুণ লাগছে। আমি প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠার পর যখন আমার অগোছালো রুমের দিকে তাকাই তখন যতটা গা গুলিয়ে আসে, এখন ততটাই দারুণ লাগছে। সত্যজিৎ রায়, আমাকে তাঁর ঠিক সামনের চেয়ারটায় বসতে বললেন। উনি বললেন, “তুমি একটু প্রস্তুতি নাও আমি স্ক্রিপ্টটা রিভিশন দিই।” আমি কি প্রস্তুতি নিবো? ট্যাক্সিতে করে অফিস থেকে আসার সময়, ছয়বার প্রশ্নগুলো রিভিশন দিয়েছি। সেটে এসে, চৌদ্দবার সেগুলো কারেক্ট করেছি। নতুন করে, হেডলাইন সাজিয়েছি। নতুন প্রশ্ন এড করেছি। শুধু আমিই না, আমার পেটের মধ্যে দৌড়ানো প্রজাপতিগুলাও আমার থেকে ভালোভাবে প্রশ্নগুলো আয়ত্ত করে ফেলেছে। আমি আর কি প্রস্তুতি নিই? আমি তাকিয়ে দেখছি, সত্যজিৎ রায় বিড়বিড় করে কিছু একটা বলছেন আর স্ক্রিপ্টে কিছু একটা লিখছেন। ঘর শান্ত। বাইরে বৃষ্টি দারুণভাবে বেড়েছে। এক ঠাণ্ডা বাতাস ঘরের ভেতরে আসছে। সত্যজিৎ রায় যেখানে বসা, তাঁর বাম দিকের ডেস্কে রাখা পাহাড়ের মতো স্তুপ জমা কাগজগুলোর একটা দুইটা পাতা হালকা উড়ছে। সত্যজিৎ রায় এখনো লিখছেন। উনি আমার দিকে না তাকিয়ে বললেন, “তুমি এখনো আনন্দতে আছো”? আমি বললাম, “আজ্ঞে, জ্বি”। উনি আমাকে আবার বললেন, “কবে থেকে জয়েন করলে”। আমি বললাম, “আট মাস”। উনি আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন, “তাহলে প্রশ্নগুলো নিশ্চয়ই ‘কেমন আছেন’, ‘এখন কি লিখছেন’, ‘নতুন সিনেমা কি আসছে’, ‘একই নায়ক নিয়েই কেনো সিনেমা বানাচ্ছি’, ‘উমুক নায়িকা কেনো এই সিনেমাটি করলো না’, ‘ফেলুদা কেনো ইদানিং একই রকম লাগে’, ‘শঙ্কু নিয়ে সিনেমা কেনো বানাচ্ছেন না’ ব্লা ব্লা রকমের প্রশ্ন সাজিয়ে এনেছো?” আমি আমার প্রশ্নের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। হুবুহু সব প্রশ্নই দেখছি মিলে গেছে। শুধু ক্রোনোলজিকাল অর্ডার উল্টা-পাল্টা হয়েছে। ওই, নায়িকার প্রশ্নটা শুধু আগে হবে।

আমি বললাম, “মিলে গেছে সব প্রশ্ন”। উনি বললেন, “এই মূহুর্তে বসে অন্য কোনো প্রশ্ন বানাতে পারবে?” আমি বললাম, “আপনি কিভাবে জানতে পারলেন?” উনি বললেন, “অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই কথা বলে।“ আমি মাথায় আরেকটি হেড লাইন পেলাম। “অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই কথা বলে”। উনি বললেন, “সবাই আসে, আর এই রকমই কথা বলে শুধু। আমাকে তুমি একই রকম প্রশ্ন করবে, আমিও তোমাকে একই রকম উত্তর দিবো। মানুষ তোমার পত্রিকা পড়ে, একই রকম স্বাদ পাবে। শুধু, দু’টো কাগজের জায়গায় চারটে কাগজ বিক্রি হবে আমার এই নামটার কারণে। তাইনা কি”? আমি মাথা নাড়িয়ে শুধু হ্যাঁ বললাম। সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা, ছোটবেলা থেকেই প্রাণকে ঠান্ডা করে দেয়,উনার নামের বইটা মনে প্রশান্তি দেয়। এইবার, সত্যজিৎ রায় আমাকে উদ্ধার করে সমাধান দিলেন। উনি বললেন, “সবাই যা করে, তুমি তা করনা। আজ সারাদিন আমি তোমাকে আমার পিছন পিছন যতটা ঘুরিয়েছি, ততটা আমি কোনো সাংবাদিককে সাথে রাখিনি। তোমার কম বয়স দেখেই বুঝেছি, তুমি এখনো পরিপক্ক হওনি। তাই, এক কাজ করো। আজ সারাদিন আমার সাথে থেকে যা যা দেখলে, তাই কালকে লিখে দাও। দেখো, মানুষ বেশী পড়বে। আমাদের জীবন সূর্যের মতো। সবাই বাইরে থেকে দেখে, আমরা জ্বলছি। তারপর, তারা ভেতরে যেতে চায় কিন্তু তাপে আর কাছে যেতে পারে না। তুমি কিছুটা এবার কাছে নিয়ে যাও। হেডলাইন দাও……” উনি কিছুটা আটকিয়ে গেলেন। হাতের ঘড়ি দেখে বললেন, “যেমন ধরো এখন বিকেল চারটা বাজে, সেই হিসেবে হেডলাইন হতে পারে ‘একদিন বৃষ্টিতে বিকেলে’। আই এম জাস্ট সাজেস্টিং।“ আমি বললাম, “জ্বি, আচ্ছা”। উনি বললেন, “চলো, বাসার পেছনের জায়গাটায় সেট পড়েছে। শেষ সময়টুকুও থাকো”। এই বলে, সত্যজিৎ রায় উঠে দাঁড়িয়েছেন। আমিও উঠলাম। উনি দরজার পেছন থেকে ছাতা নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। আমি আমার ঘাড়ের ব্যাগ মাথায় ধরলাম। উনি লম্বা পায়ে হেঁটে এতোক্ষণে অনেকদূর চলে গেছেন। আমি পেছনে হাঁটা দিলাম।

বাসার এই দিকটায় কিছুটা জঙ্গলের মতো। ক্যামেরা পলিথিনে ঢাকা আছে, আর ক্যামেরাম্যানকে খুব উত্তেজিত মনে হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর সত্যজিৎ রায়কে আর দেখতে পেলাম না। আমাকে বসার জন্য একটা চেয়ার দেওয়া হয়েছে। নাকে দারুণ একটা সুগন্ধি এসে লাগলো। বৃষ্টির পর মাটি থেকে উড়ে আসা গন্ধ না। কৃত্রিম গন্ধ। দেখলাম, কিছুদূরে নায়িকা শর্মিলা বসে আছেন। উনি হয়তোবা কফি খাচ্ছেন ট্রান্সপারেন্ট গ্লাসে। চা এর লিকার এতো ঘন না হবার কথা। আমি চারপাশে তাকিয়ে আছি। হঠাত দেখলাম, সত্যজিৎ রায় ট্রলির উপর বসে আছেন। উনি উনার মাথায় ছাতাটা ধরে রেখেছেন। এক অজানা দৃষ্টিতে তাকানো। আমি আমার ব্যাগ খুললাম, খুব সাবধানে। এক ফোঁটা পানির বিন্দু যেনো ভেতরে না ঢুকে। পলিথিনে মুড়িয়ে রাখা ক্যামেরাটা বের করলাম। তাক করলাম, সত্যজিৎ রায় এর দিকে। উনি একই অবস্থানে বসা। আমি ফ্রেম ঠিক করে, একটা শর্ট নিবো বলে শাটারে চাপ দিতে যাবো এমন সময় কেউ আমাকে এক পাশ থেকে ডেকে উঠলো। “বাবু, চা”। আমি লোকটার দিকে তাকালাম। একজন টাকওয়ালা স্বাস্থ্যবান মানুষ, গায়ে পরটার রঙের ফতুয়া আর ঘাড়ে একটা গামছা। আমি উনার দিকে তাকিয়ে কাপ হাতে নিয়ে বললাম, “এইটাকি রায় বাড়ির চা”? উনি বললেন, “আজ্ঞে, জ্বি”। তারপর উনি চলে গেলেন। আমি দেখলাম, “চায়ের রঙ কফির মতোই অনেক গাঢ়। শর্মিলার হাতের কাপের কফির মতো অনেকটাই। আমি চায়ের কাপটা নিচে নামিয়ে রাখলাম। বৃষ্টির ফোঁটা সেটার মধ্যে পড়তে থাকলো। আমি আবার, সেই ট্রলির দিকে তাকিয়ে দেখি সত্যজিৎ একইভাবে বসে আছেন। শুধু ছাতাটা উনার পাশে আধা শোয়ানো। উনি হয়তোবা বৃষ্টি শেষ হবার জন্য অপেক্ষা করছেন। আমি আবার ক্যামেরায় মনমতো একটা ফ্রেম নিয়ে ক্লিক করলাম। একটা ক্লিক, একটা দিন শেষের মূহুর্তের মতো।

পরের দিন পত্রিকায় আমার লিখা বেরিয়েছে। তার সাথে, আমার তোলা এই ছবিটি। আজ হয়তো, সত্যজিৎ রায়ের বাসার সামনে হকার খবরের কাগজ দিতে গিয়েছে। সত্যজিৎ রায়ের হাত অবধি হয়তো কাগজটা পৌঁছিয়েও গিয়েছে। উনি হয়তোবা হেডলাইন দেখে মুচকি হেসেছেন। এতে লেখা, “একদিন বৃষ্টিতে বিকেলে”।

এই গল্পের সকল প্রেক্ষাপট পুরোপুরি কাল্পনিক।

Ray sitting on a trolley, on location in Bolpur, West Bengal, during a break from filming Asani Sanket (Distant Thunder). Photo: Nemai Ghosh