দিন আসে, দিন যায়। আমি শুধু চুপ থাকি। ইদানিং কিছু বিষয় আমার আশেপাশে, আমার নিউজ ফিডে আমার প্রতিদিনের জীবনে আমার ইন্টারেস্ট না থাকা সত্ত্বেও প্রবেশ করছে। অদ্ভুত এক টুপি আকৃতির চুল ধারী লোকের হোয়াইট হাউসের গদি হরণ, শুধু মাত্র একটা সেলফি বা না গিয়েও চেক-ইন বা “আমি গান বুঝি, সংস্কৃতি বুঝি” ধরনের কিছু হাতে গোনা লোকজনের লোক দেখানো ফোক ফেস্ট নিয়ে প্রতিদিনকার সমালোচনা আর এইচডি টিভিতে ঝিরঝিরে আবছা ক্যামেরায় ধারণ করা বিপিএল এর লাইভ টেলিকাস্ট এইসবের কিছুই আমাকে গ্রাস করেনি।
আমি ভাবছি, আমিকি এতোটাই বোরিং হয়ে গেছি নিজের দুনিয়ায় থাকতে থাকতে? না কি, মানুষের যাতে ইন্টারেস্ট বেশী সেখানে আমার ইন্টারেস্ট কম? এইসবের উত্তর নিয়ে পরে লেখা যাবে। এইবার আমি আসল কথায় আসছি।

The Book Cover of ‘মিসির আলি! আপনি কোথায়?’
হুমায়ূন আহমেদ পড়া শুরু করেছিলাম আম্মুর হাত ধরে। আম্মুর বইয়ের প্রতি দুর্বলতা বেশী। তার কালেকশন সত্যি দারুণ। প্রথম বই, “মিসির আলি আপনি কোথায়?” নামটা লিখার সময় আমার গায়ে এখনো কাঁটা দিচ্ছে, সত্যি দিচ্ছে। না, ভূতের গল্প না। কিন্তু, সেইরকমই। সে সময় আমরা ভাড়া বাসাতে থাকতাম। আমি বড় মামার সাথে ঘুমাতাম। সেই বাসায় আমাদের ঘরের পাশে লম্বা বারান্দা ছিলো। রাতে মামা ঘুমাতো, আমি বইটা পড়তাম। সাদা সেই কভারটায় লাল রঙা টেলিফোনের ছবি। গল্পের প্রধান ফিমেইল প্রোটাগোনিস্ট একটু অলৌকিক। মনে হতো সে লম্বা বারান্দা দিয়ে হেঁটে এসে দরজাটা ফাঁক করে বলবে, “আমাকে কি আয়নাতে দেখা যায়?” সেই থেকে হুমায়ূন প্রেম শুরু। সেটা আজ অবধি আছে।
কিন্তু, ইদানিং কালে আমি কষ্ট পাই হুমায়ূন আহমেদের নাম শুনলে বা তার প্রসঙ্গ উঠলে। ভার্সিটি তে একদিন ক্লাসে হুমায়ূন আহমেদ প্রসঙ্গ উঠলো। শিক্ষক মশাই টেকনিকালি হুমায়ূন আহমেদ এর তুলোধোনা করলেন। আমি বললাম, “বলে কি?” পাশের জন দেখলাম খুব সায় দিচ্ছে শিক্ষকের কথায়। বললাম, “তুমি হুমায়ূন আহমেদ পড়না?” সে তার মুখ বাঁকা করে উত্তর দিবো, “ইয়ু, না।” আমি অবাক হয়ে তাকালাম। সে আমার বয়সী, কিংবা একটু ছোটই হবে। তার মতো সৃজন মনা একজনের কাছ থেকে এইটা আশা করিনি। কষ্ট তার “না” বলাতে লাগেনি। কষ্ট লেগেছে, তার সাত জনমের বাঁকা মুখ দেখে। কষ্ট শিক্ষক মশাই এর হুমায়ূন অপ্রীতি তে লাগেনি। কষ্ট লেগেছে, উনার “হুমায়ূন আহমেদ বাংলা লিটারেচারে কি করেছেন?” মূলক প্রশ্ন থেকে। হুমায়ূন আহমেদ বেঁচে থাকতে আমার বয়সী যেসব পাঠক তার নাম জমতে জমতে মুখে ফেনা তুলতো, তারা যখন আজ উনি মারা যাবার পর বর্তমান সময়ে “আমার ভিনদেশী তারা” এর মতো “আমার ভিনদেশী লেখক” নিয়ে মাতামাতি করে নিজেকে স্মার্ট সাজাতে ব্যস্ত তা দেখে আমার কষ্ট লাগে।

Google Doodle on Humayun Ahmed’s 69th Birthday
“ধুর, হুমায়ূন আহমেদ পড়িনা”, “ইয়ু, হুমায়ূন পড়ি না”, এইসব বাক্য কি ইদানিং নিজেকে স্মার্ট প্রমাণ এর পন্থা? লাস্ট সেমিস্টারেও যখন সকালের ঘুম বাদ দিয়ে ভার্সিটি যেয়ে এক শিক্ষকের মুখে হুমায়ূন আহমেদ কে তুলোধোনা হতে শুনতাম কষ্ট লাগতো। হ্যাঁ, জেনারেশন পাল্টালে রুচি পাল্টাতে পারে কিংবা একই জেনারেশন এর কাল বিশেষে রুচি পাল্টাতে পারে। কিন্তু, শিক্ষক তাও আবার লিটারেচার এর শিক্ষক দের কাছে এই ধরনের রেসপন্স আমি চিন্তা করিনি। শিক্ষক বলেই যে হুমায়ূন আহমেদ ভালো লাগবে, এইটা অবশ্যই কম্পালশারি না। কিন্তু, এমন যুক্তি? এর থেকে তো পার্শ্ববর্তী দেশের “আনন্দবাজার” হুমায়ূন আহমেদের গুণ বেশী গায়। গুণীর কদর এর ক্ষেত্রে আমরা বরাবরই আনাড়ি। দাঁত থাকলে দাঁতের মর্ম যেমন বুঝি না, দাঁত চলে গেলেও মাঝে মাঝে তার মর্ম বুঝি না।

Himu Illustration. Source: Internet
আমাকে শুনতে হয়, লেখালেখির অভ্যাস কখন থেকে। আমি কখনো সত্যি উত্তর টা দিই না। শুধু বলি, “এই হবে হয়তো। এইসব তো বলে কয়ে আসে না, শুরু করেছি হয়ে গেছে।” কিন্তু না। আসল উত্তরটা অন্যখানে। আমার লেখালিখির রসদ জগিয়েছেন আমার মা। বাচ্চারা পায়ের উপর বসে ঝুলার একটা খেলা খেলে। যিনি পা দিয়ে তুলেন, তিনি বলেন “দোল দোল দোলনি, রাঙা মাথায় চিরুনি।” কিন্তু, আম্মু গায়তো আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো। আম্মু যখন, “ছেলে হারা শত মায়ের অশ্রু” বলে আমার দিকে তাকাতো সেই কষ্ট যেনো আমি বুঝতে পারতাম। তারপর, রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলের আগমন। ভোরে লাল সোয়েটার, সাদা শার্টের নিচে সবুজ প্যান্ট পড়ে যখন স্কুলের পিটি করতে যেয়ে চোখ ছলছল অবস্থায় জাতীয় সংগীত গাইতাম তখন স্কুল মাঠের আম গাছ গুলা থেকে বেরিয়ে আসা কাষ্ঠ রসের গন্ধ আর জাতীয় সংগীতের লাইন আমাকে রবীন্দ্রনাথ কে চিনিয়েছে। আমার এক কাজিনের বাসায় গানের শিক্ষক আসতেন। তারা কয়েকজন হারমোনিয়াম নিয়ে বসতো। একটা খাতায় লাইন লেখা ছিলো, “চল চল চল। উর্দ্ধ গগনে বাজে মাদল।” তারা আমার সামনে গায়তে লজ্জা পেতো। আমি তাই গানটা পড়ে নিয়ে, নিজে থেকে আড়ালে গাইতাম। সেই থেকে নজরুলের আবর্তন। আর, তারপর হুমায়ূম আহমেদ। আব্বু একবার গল্প শুনিয়েছিলো, তিনি কিভাবে বর্ষার সময় গ্রামের কাঁদা রাস্তা পাড়ি দিয়ে রাতের বেলা বাড়ি থেকে পালিয়ে “আজ রবিবার” “বকর ভাই” দেখতে যেতেন। সেই থেকে আমার ইন্টারেস্ট। হুমায়ূন আহমেদ আমাকে শিখিয়েছেন।
প্রশ্ন আসবে, কি শিখালেন এই লোকটা। যে নাকি বাংলা লিটারেচার এ কি করেছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠে। এমন লোক, সত্যি কি কিছু শিখাতে পারে? প্রশ্নকর্তা বলবেন, “নিছক মনোরঞ্জন ছাড়া আর কিছু থাকলে বলবেন। মানে হচ্ব্যছে, ব্যক্তিগত জীবনের মনোরঞ্জন আরকি।” আমি মৃদু হেসে বলবো, “দাঁত খিলানো বন্ধ রেখে কথা শোনেন।” আমাকে বিশাল বিশাল বাক্যে অনুভূতি না লিখে কিভাবে সোজা ভাবে ছোট বাক্যে অনুভূতি প্রকাশ করতে হয় তা শিখিয়েছেন, শীতে কাঁথা মুড়ি দিয়ে আঁটসাঁট ভাবে শুয়ে গল্পের বই পড়তে শিখিয়েছেন, ভোরে খেঁজুর গাছের নিচে বসে খেঁজুর রস খাওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছেন, ঝরঝরে গরম ভাত ঘি দিয়ে আরাম করে কিভাবে খেতে হয় তা শিখিয়েছেন, ঝুঁটি বাঁধা মেয়ের সাথে প্রেম, খোলা ছাদে জোছনা দেখা আর সাপ তাড়ানোর ঔষধের নাম শিখিয়েছেন, বোন আর মায়ের মধ্যে মমতার কোনো পার্থক্য নাই সেটা আমার মাথায় ঢুকিয়েছেন, আমাকে পাঞ্জাবি পড়তে শিখিয়েছেন, সুন্দর মানে কালো হয় সুন্দর মানে ইংরেজিতে কথা বলা নয়, সুন্দরতা থাকে ক্ষুধার্ত মানুষের এক প্লেট বিরিয়ানি খেতে দেখার মধ্যে উনি আমাকে তা বুঝিয়েছেন। আর শিখিয়েছেন সব চেয়ে অমূল্য শিক্ষা। নিজের স্বপ্নের পেছনে দৌড়ানো। যা তুমি, তা হতে পারা টা। কেমিস্ট্রির গাছ হয়েও যে, পেশায় লেখক হওয়া যায় উনি তা শিখিয়েছেন।
কাউকে জোর করে হুমায়ূন প্রেমিক বানানো আমার ইচ্ছা না। যে বলুক যা ইচ্ছা। হুমায়ূন আহমেদ আমাকে বাংলা গল্পের বই হাতে নিতে শিখিয়েছেন। আমি স্মার্ট না হলাম। আমি জানি আমি কি। নিজের মহত্ব নিয়ে গর্ব করতে যিনি শিখিয়েছেন, আজ তার জন্মদিনে তাকে স্মরণ করছি। এরা না বুঝলেও, আমার মতো বোরিং কিসিমের মানুষ আপনাকে বোঝে। ভালো থাকুন। আল্লাহ্ আপনাকে জান্নাতবাসী করুক, আমিন।