আমাদের আবার দেখা হবে (We Will Meet Again)

আমাদের আবার দেখা হবে (We Will Meet Again)

Rajiul Huda Dipto is a professional screenplay writer and working for years in the Bangladeshi TV industry. Besides that, he introduces himself as a photographer, whose photographs have been featured in various magazines and exhibitions all around the world. Not regularly, but he publishes his works in national dailies as well. Currently, he is working as a community writer in BuzzFeed and a contributor in Getty Images.

সহস্র বছর মানে ঠিক কতদিন?

অংকে আমি বরাবরই কাঁচা তবে,

মনের হিসেবে একদম ঝানু,

হোক শত সহস্র বা ততধিক, আমাদের আবার দেখা হবে

সুস্থ শহরের অসুস্থ মনা মানুষগুলোর ভীড়ে,

আমাদের আবার দেখা হবে।

যখন সমুদ্রের পাশে কেজি দরে বিক্রি হবে গোলাপী ডলফিনের মাংস,

আমাদের সেদিন আবার দেখা হবে।

আমরা ভুলে যাবো আজকের এই মহামারির কথা,

ভুলে যাবো বিশ্বে আকাল পরেছে মাস্ক, পিপিই কিংবা সাধারণ মনুষ্য জ্ঞানের

ভুলে যাবো অভাব পরেনি সেদিন একনিষ্ঠ ভালোবাসার,

দূরত্ব কি ভালোবাসা বাড়ায়?

আমাদের ভালোবাসা তো তবে বেড়েছে সরকারি ব্যাংকের সুদের হারে,

আবার যখন অর্থনৈতিক মন্দার চাপে জর্জরিত থাকবে ভাইরাসের কোলে মাথা দিয়ে ঘুমানো এই বিশ্ব,

আমাদের আবার দেখা হবে।

বাজলো কলিংবেল

বাজলো কলিংবেল

Rajiul Huda Dipto is a professional screenplay writer and working for years in the Bangladeshi TV industry. Besides that, he introduces himself as a photographer, whose photographs have been featured in various magazines and exhibitions all around the world. Not regularly, but he publishes his works in national dailies as well. Currently, he is working as a community writer in BuzzFeed and a contributor in Getty Images.

গোসল থেকে বের হয়ে শাড়ির আঁচল ঠিক করছে শায়িরা। শাড়ির আঁচল ঠিক করা খুব সহজ কোনো বিষয় না। ভাঁজের দিকে বিশেষ মনোযোগ দিতে হয়। আঁচলের ভাঁজ একের সাথে আরেক লেগে গেলেই সমস্যা। একদম টানটান আর আলগা হওয়া লাগে। ছোটবেলায় খেলার ছলে মায়ের শাড়ির আঁচল ঠিক করতে গিয়ে পুরো বিষয়টি আয়ত্ব করে ফেলেছে সে। মাথায় বেণী করে কাকভেজা চুলে আকাশী তয়লা জড়িয়ে রেখেছে, মায়ের মতো। কোমরের নিচ অবধি চলে গিয়েছে চুল শৃঙ্খলার সাথে। আঁচল ঠিক করতে করতেই নাক শিঁটকোয় শায়িরা। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির সময় আশেপাশের ময়লার গন্ধ জীবন্ত হয়ে ওঠে। তীব্রতার সাথে নাকে ঢোকে।

ইলিশ মাছের আঁশটে গন্ধ তার নাকে ঢুকছে, খোলা জানালাটা দিয়ে ভেতরে আসছে গন্ধটা। সে তার আঁচল ঠিক করায় মন দেয়। সাথে এইটা ভেবে বিরক্তি হয় যে, কাজের বুয়া আজ যাবার সময় আঁশটে বাড়ির পাশেই ফেলে এসেছে। খুব বিরক্তকর।

কলিংবেলটা বেজে ওঠে। খুব তাড়াহুড়োয় আছে এমন কেউ বেলটা বাজায়নি। বেশ কিছুক্ষণ চেপে রেখে তারপর সুইচ থেকে আঙুল সরানো হয়েছে। এই সময় আবার কে এলো? বুয়া কি কালকের ভাতগুলো নিয়ে যেতে ভুলে গেলো? কিন্তু, সে তো এতো ধীরস্থিরভাবে বেল চাপেনা। আর, একসাথে গুনে গুনে চারবার টেপে। তাহলে কি ফয়সাল? সে এই সময় কেনো আসতে যাবে? সেও তো চটজলদি অবস্থাতে বেল চাপে। এতো ধৈর্য তার নেই। গুনে গুনে দুই বার। কিন্তু, এতো খুব ধীরে চেপেছে, তাও আবার একবারই চেপে আর কিছু বলছে না। পাড়ার বদমাস বাপ্পি কি বেল চিপে পালিয়ে গেলো? তাও আবার এই বৃষ্টিতে?

শায়িরা এতোকিছু ভাবতে ভাবতে দরজা পর্যন্ত যায়। মাথাতে বেণী করা তয়লাটা পেছনে ঝুলছিলো। সে সামনে করে নেয়। গালের পানির ফোঁটাগুলো হাত দিয়ে মুছে ফেলে। তারপর দরজা খোলে। আধুনিক যুগের দরজা নয়। উপরে সিঁকি দেয়া দরজা। সিঁকিটা নিচে পড়ে গেলে ‘ঠক’ করে একটা শব্দ হয়। সামনে রাহাত দাঁড়ানো। পুরোদস্তুর ফরমাল গেটআপ পরানো। চুলগুলো দেখলেই বোঝা যায় সিঁথি করা ছিলো। বৃষ্টি আর দক্ষিণ কোণের বাতাস এলোমেলো করে ফেলেছে অনেকটাই। চোখে চশমা আগের মতোই। চেকচেক নীল শার্ট, ব্যাংকাররা যেমন পরে। শায়িরা দু’হাতে দরজার দু’টি দিক ধরে দাঁড়িয়ে আছে। বাইরে প্রচন্ড শীতল অসভ্য বাতাস। খুব ঠান্ডা লাগা শুরু করেছে তার। তবে, শাড়ির আঁচলের কোনো সমস্যা হচ্ছে না। বিশ্রিভাবে পেট থেকে শাড়ির কিছু অংশও সরে যাচ্ছে না। সত্যিই শাড়ি পরাটা বেশ ভালো করেই আয়ত্ব করতে পেরেছে শায়িরা। তবে, শায়িরার পেট গুড়গুড় করছে। হৃদকম্পন অনেকটা বেড়ে গিয়েছে বললে, খুব তথাকথিত বিষয় হয়ে যাবে। তার হৃদকম্পন শিথিল হয়ে গেছে। ভ্রু কপালের ভাঁজের মতো কুঁচকে গেছে।

“তোর বাসা?”, অপ্রস্তুতি আর উৎকন্ঠা জড়িত কন্ঠে বলে ওঠে রাহাত। “হ্যাঁ”, বলার সাথে সাথেই শায়িরার ঠোঁটের উপরের তিলটা কেঁপে ওঠে। রাহাত বলে, “কেমন আছিস?” শায়িরা বলে, “তুই হঠাৎ এইখানে?” রাহাত হাতের কাগজের ফাইল দেখিয়ে বলে, “আসলে একটা ডকুমেন্ট দেয়ার ছিলো ফয়সাল নামের এক ভদ্রলোককে।” তারপর সে ফাইলের উপর লেখা ঠিকানাটা পড়ে বলে, “এইখানে ঠিকানা তো এইটাই দেয়া আছে।”

“নাম-ঠিকানা ঠিকই আছে”, বলে শায়িরা। বাইরে দমকা হাওয়া আরো বেড়ে যায়। শুধু রাহাতেরই না, দরজাটা খুলে দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে শায়িরারও। রাহাত ফাইলটা শায়িরার হাতে দেয়। শায়িরা ফাইলটা হাতে না নিয়ে বলে, ” এখনতো যেতে পারবি না। ভেতরে আই।” রাহাত ভেতরে যায়। শায়িরা দরজা লাগিয়ে দেয়।

“বস,” বলে শায়িরা।

“থ্যাংক ইউ,” বলে সিংগেল সোফাটায় গিয়ে বসে রাহাত। শায়িরা এতোক্ষণে নিজেকে অনেকটাই সামলে নিয়েছে। টানা পাঁচ বছর বাদে রাহাতের সাথে দেখা। অনেক কিছু পাল্টে গেছে এতোগুলো দিনে। পাল্টেছে দু’জনেরই উপলব্ধি। বৈজ্ঞানিক এক গবেষণার ফল বলে, টানা ছয় মাস আপনার অতি আপনজনকে না দেখে থাকলে আবছা হয়ে তার চেহারা আপনার মাথা থেকে চলে যায়। এক বছরে গিয়ে তা আরো প্রকট হয় আর ধীরে ধীরে এটি তীব্রতর হয়। পাঁচ বছর, অনেক সময়। চেহারা ভুলে গিয়েও, কয়েক সেকেন্ডের দেখায় আবার পুরোটা মনে পরে গেছে দু’জনেরই।

শায়িরা বলে, “ফয়সাল আমার হাজবেন্ড।” রাহাত বলে, “ও।”

– “ফাইলটা কিসের?”

– “উনি তো লোনের জন্য এপ্লাই করেছিলেন বেশ কিছুদিন আগে।”

শায়িরা ফাইলটা হাতে নিয়ে দু’একটা পাতা উল্টিয়ে বলে, “হয়ে গেছে?” রাহাত বলে, “না, কিছু কারেকশন আছে। সেটা উনাকেই করতে হবে। তাই, ফাইলটা উনাকে দিতে আসা।”

– “তুই তাহলে লোন ডিপার্টমেন্টে আছিস?”

– “না। আসলে ফাইলটা আমার দিতে আসবার কথাই নয়। আমার জুনিয়র আবু তার দেয়ার কথা। আমিতো এই ব্রাঞ্চেই কাজ করিনা। চট্টগ্রামে আছি। আজ একটা কাজে এসেছিলাম। আবু আমার খুব কাছের। সে প্রচন্ড ব্যস্ত ছিলো, ভাবলাম আমার যাওয়ার পথেই পড়বে যেহেতু ওর কাজটা কমিয়ে দিই।”

– “পরোপকারিতা আজও যায়নি তাহলে?”

– “আজ পরোপকারিতার জন্যই কিন্তু তোর সাথে দেখা হয়ে গেলো। পাঁচ বছর পর।”

– “তুই না বলেছিলি, কখনো দেখা করবিনা?”

– “হুম। তুইও কি চেয়েছিলি?”

– “হয়তো। চা খাবি?”

– “না, আমার এক ঘন্টা বাদেই ফ্লাইট। চট্টগ্রাম গিয়েই লাঞ্চ করবো।”

– “এতো বৃষ্টিতে যাবি কিভাবে?”

– “গাড়ি আছেতো।”

– “এইখানেই লাঞ্চটা করে যা।”

– “এর আগে যতবারই তোর বাসায় গিয়েছি, আমার কিন্তু লাঞ্চটা করা হয়নি।”

– “কিন্তু প্রতিবারই তুই আসলে ফ্রিজে পায়েস থাকতো। বস নিয়ে আসি।”

রাহাত বারণ করতে যাবে। শুনলোনা শায়িরা। পিঠ দেখিয়ে ডাইনিং এর দিকে চলে গেলো সে। ফাইলটা হাত থেকে টেবিলে রেখে চারপাশে তাকালো রাহাত। খুব যত্নের সাথে পুরোনো বাড়িটাকে নতুন করে সাজানো হয়েছে। দেয়ালে বেশ বড় একটা টিভি, অনেকগুলো সোফা। ডাইনিং পাশেই। রান্নাঘরটা দেখা যায়। সোজা তাকালে হয়তো শোবার ঘর দেখা যাচ্ছে। হাতের বামে মেইন দরজা পার করে আরেকটি ঘর মনে হচ্ছে। রান্নাঘরের পাশেই কি বারান্দা? যেমনটা শায়িরা চেয়েছিলো। মনে প্রশ্ন জাগে রাহাতের। তবে, শোবার ঘরের উল্টো পাশ দিয়ে একটা সিঁড়ি চলে গেছে উপরের দিকে। সেটা কি উপর তলার সিঁড়ি না কি ছাদে যাবার? ঠিক শায়িরা যেমনটা চেয়েছিলো।

শায়িরা পায়েস নিয়ে এসেছে। সাথে ফালুদা আর দু’টো মাছ ভাজা। রাহাত একটু হেসে বলে, “মাছা ভাজা?” শায়িরা বলে, “হুম। তোর কত প্রিয়। আর দেখ, কাকতালীয়ভাবে আজকেই ভাজলাম।”

রাহাত বলে, “পায়েস আর ফালুদা কি তোর বানানো?” শায়িরা বলে, “হ্যাঁ।” পায়েসটা মুখে দিয়ে রাহাত বলে, “একদম তোর মায়ের মতো হয়েছে। শ্বশুর বাড়ি পাঠানোর আগে নিশ্চয় হাতে কলমে শিখিয়েছেন উনি।” এরপর ফালুদা মুখে দিয়ে রাহাত বলে, “মিষ্টি বেশ কমিয়ে দিয়েছিস। ফালুদা বানানো ভুলে গেছিস নাকি?” শায়িরা বলে, “না, আসলে ফয়সাল বেশী মিষ্টি পছন্দ করে না। তাই, একটু ধরন পাল্টাতে হয়েছে।” “আচ্ছা,” বলে রাহাত।

শায়িরা মাথার তয়লাটা খুলে এসেছে। মেয়েদের চুল ভিজে থাকলে কুঁকড়ে থাকে। সেরকমই হয়ে আছে শায়িরার লাজুক চুল। ডান চোখের ঠিক পাশটা দিয়ে বেয়ে গেছে চুলের দেয়াল। আরো উজ্জ্বল লাগছে শায়িরাকে। আরো পরিপূর্ণ। দেখলেই বোঝা যায়, ভালো আছে শায়িরা। সবই আছে, পেয়েছে সবকিছুই। কিন্তু, কোনো মানুষের জীবনতো সম্পূর্ণভাবে পরিপূর্ণ হয়না। না পাওয়ার মধ্যে রাহাতকে পাওয়াটাই বাকি থেকে গেছে হয়তো।

“কেমন হয়েছে মাছ ভাজাটা?” জিজ্ঞেস করে শায়িরা। রাহাত বলে, “দুর্দান্ত। হাল্কা আঁচে বেশ কড়া করে ভাঁজা।” শায়িরা বলে, “যাক, সন্তুষ্ট করা গেছে দেখছি তোকে তাহলে।”

– “একটা প্রশ্ন করি।”

– “কর।”

– “তোর রান্নাঘরের পাশে কি বারান্দা?”

– “কিভাবে বুঝলি?”

– “তুই সবসময় চায়তি এমনটা হোক, তাই ভাবলাম পেয়েছিস কি না।”

– “হুম, পেয়েছি।”

– “সিঁড়িটা বেয়ে কি ছাদে যাওয়া যায়?”

– “না, উপরে বাবা-মা থাকতেন। দুই বছর হলো উনারা মারা গেছে।”

– “তাহলে এই পাওয়াটা পূরণ হয়নি।”

– “সব পাওয়া কি পূরণ হয়?”

– “নাহ।”

– “তবে উপর তলাটা পার করেই ছাদ।”

– “কতগুলো গাছ আছে ছাদে?”

– “অনেকগুলো গাছ। বেশ কয়েকদিন থেকে যত্ন করাই হচ্ছিলোনা। বৃষ্টিটা হয়ে ভালো হয়েছে।”

– “হুম।”

– “তোর কথা বল। বিয়ে কবে করলি?”

– “কিভাবে জানলি বিয়ে করেছি”

– “করসনি?”

– “হুম, করেছি।”

– “কি নাম?”

– “স্নিগ্ধা।”

– “বাহ, কি করে।”

– “একটা নিউজপেপারে আছে৷ ঢাকায়।”

– “দুইজন আলাদা থাকিস? ছেলে-পুলে হবেনা তো।”

– “হাহাহাহাহাহা, যাওয়া আসার মাঝেই থাকি। তোরা তো একসাথেই থাকিস। বাচ্চা নিসনি।”

– “নিবো তো। আগে তুই নে।”

হাসতে শুরু করে রাহাত। এরমধ্যে মধ্যস্থতা বৃষ্টি কমে এসেছে। রাহাত বলে, “আমাকে যেতে হবে। ফ্লাইটের সময় হয়ে আসছে প্রায়।” শায়িরা বলে, “তোর না এরোফোবিয়া ছিলো? বিমানে চড়তে ভয় পেতি।” হাল্কা হেসে রাহাত বলে, “ভয় তো তোকে হারানোরও পেতাম। হারাতে তো হলোই।” শায়িরা বলে উঠে, “এতোদিন বাদে দেখা হলো। এখনো অভিমান আমার উপর।”

– “অভিমানটা হয়তো সময়ের উপর।”

– “আমাদের কি কোনো দোষ নেই?”

– “ঘুণাক্ষরেও যার কথা ভাবিনি, তাকে হঠাৎ করে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। সেও বেসে ফেলেছিলো। দোষটা কোথায়?”

– “জানি না।”

– “আমি আজ এসেছিলাম, তোর জামাইকে বলবি?”

– “কেনো বলবোনা?”

– “ওকি আমাদের ব্যাপারটা জানে?”

– “তোর বউ জানে?”

– “হুম, জানে।”

– “একটু বস। চা বসিয়েছি।”

– “আজ আর খাবো না। দেরী হয়ে যাচ্ছে খুব।”

– “আচ্ছা। আমি আসছি।”

শায়িরা প্লেটগুলো নিয়ে ভেতরে চলে গিয়ে চুলো বন্ধ করে বেরিয়ে আসে। রাহাত উঠে দাঁড়িয়েছে আগেই। দরজার কাছে দাঁড়ানো আছে। শায়িরা গেইট খুলে দেয়। রাহাত বলে, “তোর মনে আছে আমাদের দেখা হলেই আমার সবচাইতে অপছন্দের বিষয় কি ছিলো।” শায়িরা বলে, “বিদায় জানানো।” রাহাত বেরিয়ে বলে, “আজও তাই। চলি।”

একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে গেটের কাছেই। রাহাত সেটায় উঠে পড়েছে। শায়িরা বলে, “ভালো থাকিস। আল্লাহ হাফেজ।” খুব কষ্টে গালের কোণে এক চিলতে হাসি দেখা যায় রাহাতের। গাড়ি চলতে শুরু করে৷ প্রচন্ড ঠান্ডা। গাড়ির মধ্যে এসি চলছে। দাঁতে দাঁত চিপে বসে থাকে রাহাত। চোখে চোখ চেপে বসে থাকতে পারেনা সে। একটু ভিজে আসে কোণটা।

শায়িরা কেবল দরজাটা লাগিয়ে ভেতরে গেছে। টেবিলের উপর রাহাতের রেখে যাওয়া ফাইলটা পড়ে আছে৷ সে ফাইলটা তুলে নিয়ে তার শোবার ঘরে যায়। একবার খুলেও দেখে না। বিছানার উপর ফেলে রাখে সেটা। এরপর ফাইল কেবিনেটের প্রথম ড্রয়ারটা খুলে একটা ফাইল বের করে। বিছানায় পরে থাকা ফাইলটার কাছে এসে রাখে।

রাহাতের দেয়া ফাইলটার প্রথম পাতা খোলে শায়িরা। ব্যাংকের নাম যে জায়গাটায় লেখা, তার পাশে একটা কালো কালির টান। হালকা আঁচড় লাগলে যেমনটা দেখায় সেরকম। এবার ফাইল কেবিনেট থেকে বের করা ফাইলটার প্রথম পাতা খোলে শায়িরা। এইখানেও ব্যাংকের বড় করে লেখা নামটার পাশে একটা কালির দাগ, একইরকম দাগ। দু’টো ফাইলেরই পাতা ওল্টাতে থাকে শায়িরা। কাগজের মার্জিন থেকে শুরু করে লেখা সবকটি ফিগার, সবকিছুই হুবুহু একই। মুচকি হেসে ওঠে শায়িরা।

কিছুদিন আগে লোনের এই কাগজটা ব্যাংক থেকেই বাসায় দিয়ে গেছে। শায়িরা নিজেই রিসিভ করেছে৷ আজ যখন সে রাহাতের কাছ থেকে ফাইলটা পায়, সে জানতো এইটা সেই ফাইল। হুবুহু সেটাই। সে জানতো, রাহাত কোনো ফাইল দিতে আসেনি। শুধু এসেছিলো তাকে দেখতে। রাহাতের থেকে যাওয়া পুরো সময়টা জুড়ে শায়িরা জানতো এই সবকিছুই। তবুও, সে কিছু বলেনি। কেনো বলবে? তারও তো তাকে দেখতে ইচ্ছা করছিলো৷ কেনো বলবে? সেও তো চেয়েছিলো রাহাত আসুক তার পছন্দের নীল রঙের চেকচেক শার্ট পরে। কেনো বলতে যাবে সে? শায়িরা তো নিজেই চেয়েছিলো দু’জন মিলে বৃষ্টিতে ভিজতে। হোক না সেটা দরজায় দাঁড়িয়ে ঠিক দু’জন অচেনার মতো।

শহরটা আবার ভিজে একাকার। গলির মোড়ে রাস্তাটায় পানি জমেছে, বৃষ্টি কমেছে। বাইরে লোকজন বেরিয়ে এসেছে। আবছা হওয়া জানালার কাঁচে গুটিগুটি দানা বেঁধেছে বৃষ্টির পানির দাগ। বিকেল বেলাটা বুড়িয়ে গেলো কেমন করে। বয়স বেড়ে সন্ধ্যা হয়ে এলো আবার। টেবিলের খাবারগুলো জমে ঠান্ডা। ডাল তার স্বাদ হারিয়েছে ঠান্ডা হয়েই। ভাতগুলো ঠিক মনের মতোই শুভ্র শ্বেত। চেয়ারগুলো ফাঁকা পড়ে আছে। ছাদের গাছগুলো এতোটা ভিজতে চায়নি হয়তো। রান্নাঘরের বারান্দাতে পুরোনো যত চেয়ার-টেবিলে ঘুণ পোকারাও ভিজে একাকার। দম নিচ্ছে একটু করে। ডিসওয়াশারে একাকী প্লেট পড়ে আছে নিজের মতোই। চা ফুটলো ঠিকই, তবে ঢালা হলোনা প্রিয় কাপটায়।শাড়ির আঁচল জীবনের মতোই নিয়ম মাফিক রয়ে গিয়েছে। সিংগেল সোফাটার কুশন এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে। চুলগুলো যেই না শুকাতে চায়লো, বেজে উঠলো কলিংবেল। আবারো দরজা খোলার আশায়, আবার বেজে উঠলো কলিংবেল। দরজা খুলেই যাকে প্রতিবার দেখতে চাই, সে আসবে বলে হয়তো বাজলো একটি কলিংবেল।

খসখসে চিঠি (Rough Letter)

খসখসে চিঠি (Rough Letter)

Rajiul Huda Dipto is a professional screenplay writer and working for years in the Bangladeshi TV industry. Besides that, he introduces himself as a photographer, whose photographs have been featured in various magazines and exhibitions all around the world. Not regularly, but he publishes his works in national dailies as well. Currently, he is working as a community writer in BuzzFeed and a contributor in Getty Images.

 

প্রিয় শুভাসী,

কম্পিউটারের টিপ টিপ বা মোবাইলের ট্যাপ ট্যাপ শব্দের চেয়ে আখের ছোবড়া দিয়ে বানানো কাগজের উপরে তিনটা দোকান ঘুরে বের করা, বাজেটের থেকে বেশী দাম দিয়ে কেনা Classic Ink Pen এর খসখস শব্দ আমার বেশী প্রিয়। তাই, তোমাকে চিঠি লিখি।
এই শহরে পোস্টবক্স দেখলে জনার্দনের চায়ের দোকানের কথা মনে পড়ে। আগে যে শহরে ছিলাম, সেখানে তার চায়ের দোকানের পাশেই পোস্টবক্স টা ছিলো কি না। প্রতি সপ্তাহের বৃহস্পতিবার আমি চা খেয়ে চিঠি ফেলে যেতাম। এখন এই শহরে কাওরানের উলটো দিকে একটা পোস্টবক্স দেখি। তার রঙ আমার স্মৃতির মতোই লাল। এখানে আসার পর সেই বক্সে প্রায় দুই সপ্তাহ চিঠি ফেলেছিলাম। তোমার কোনো উত্তর না পেয়ে, খোঁজ নিয়ে দেখলাম যে তোমার শহরে পোস্ট অফিস এখন শুধুমাত্র টাকা জমা রাখার স্থান। Post man আর তালে তালে চিঠিতে খ্যাটর খ্যাটর করে সিল মারেননা। তাই আর চিঠি পাঠাইনি। তবে, লিখা ছাড়িনি।

চলে আসার সময় দুটো ওয়াদা করেছিলাম, মনে আছে? এক তোমাকে ভোলা চলবে না আর দুই চিঠি লিখবো। লিখে যাচ্ছি। এই চিঠি তো তোমাকে পোস্ট করা হবে না। তাই, আমার অর্ধেক ভাঙা (আদতে কিছু টা বেশী) কাপড়ের ড্রয়ারের দুই নাম্বার পাল্লায় কোণার দিকে সব চিঠিপত্তর রেখে দিবো ঠিক তোমার দেয়া পচতে থাকা সানগ্লাসের বাক্সটার উপরে।
আচ্ছা, তোমাদের বাসার উলটো দিকের মসজিদে পাঁচ ওয়াক্তের আযান কি এখনো একি রকম সুরে বাজে? আযানের সময় হুজুর সাহেব কি এখনো নাকে বেশী টান দেন?

তোমার বাবা কি এখনো প্রতিদিন ছাদে বসে বসে মেহেদি তুলেন আর দাঁড়িতে লাগান?
উনি এখনো কি দুপুরে শিঙাড়া এনে খাওয়ান?
তোমার মা কি আর পায়েস রাঁধেন না?

ছাদে গিয়ে চুপ করে আমার সাথে ফোনে কথা বলার সময় পাশের বাড়ির ছোট্ট মেয়েটা তোমাকে দেখে আর আপু আপু বলে চিতকার দেয় না?
তোমার বাসার সামনে সাইকেল নিয়ে পায়চারি করা আট বছরের ছেলেটা কি এখনো তোমায় দেখে লজ্জা পায়?
মোড়ের বয়স্ক লোকটার দোকান থেকে কি আর রিচার্জের কার্ড নাওনা?
চুল কাটাতে পার্লারে যাও? নাকি অনেকদিন হয় না?

ফিজিক্স প্রফেসরের ওই গলিতে গোলাপি ব্যাগ নিয়ে স্যান্ডেল খসখস করে হাঁটতে হাঁটতে আর যাওনা না?
এখনো কি হাফ খাওয়া চকোলেট ফ্রিজে থেকে থেকে expired হয়ে যায়?
মশারি কি এখনো টাঙাও?

আর ফালুদা? শেষ বার কবে বানিয়েছো?
আমাকে কি মনে পড়ে?
এখনো ফোন দিতে ইচ্ছা করে?
করেনা না?

নাই করুক। ফোন দিয়ো না তো। আমি আমতা আমতা করবো, তুমি নোনতা নোনতা করবে। তার থেকে বরং আমাকে চিঠি লেখো। আর সেই চিঠি রেখে দিয়ো ওই ড্রয়ারের মধ্যে যেখানে পচছে আমার দেয়া আংটির বাক্সটা।
পোস্টবক্স নাহয় খালি থাকলো। খাম ভরুক স্মৃতি দিয়েই।

ইতি,
Ink pen এর কালি শেষ।

আমি ফেরত যেতে চাই (I want to go back)

আমি ফেরত যেতে চাই (I want to go back)

Rajiul Huda Dipto is a professional screenplay writer and working for years in the Bangladeshi TV industry. Besides that, he introduces himself as a photographer, whose photographs have been featured in various magazines and exhibitions all around the world. Not regularly, but he publishes his works in national dailies as well. Currently, he is working as a community writer in BuzzFeed and a contributor in Getty Images.

ব্রিটিশ কাল এই বাংলা ছেড়ে চলে গেছে ঠিকই,কিন্তু বিকাল ও সন্ধ্যার মধ্যবর্তী সময়টা তে আজও তারা বাস করে। আমি জানিনা,এই সমস্যা শুধু আমার হয় না কি অন্য দেরও কিন্তু এই নির্দিষ্ট সময়টা কিছুটা western western মনে হয়। Western মানে হানগামা নাচানাচি typeএর নয়,এটা খুবই শান্ত ও মন খারাপ ধরনের। মনে হয় সেই সময়ের কষ্টগুলো এই বিশাল শহরের বিশাল দালান ধরে ধরে কাঁদছে আবার মনে হয় সেই সময়ের সুখগুলো আমাদের দিকে তাকিয়ে বলছে,”কি? পারলেনা তো ধরে রাখতে?”

যখন গ্রাম এলাকায় যাই,এই জিনিসটা বেশী অনুভূত হয়। ধানের চাতালের ঠান্ডা মাটিতে বিরহ বাস করে। স্যাঁতসেঁতে দেয়ালে যখন শেষ সূর্যটা তার ছাপ রেখে যেতে চায়,হুঁ হুঁ করে কাঁদতে থাকে দেয়াল বেয়ে চুইতে থাকা পানি। আর সেটা দেশের যে জায়গায় হোকনা কেন,একি সময়ে প্রতিটা দিন একি ধরনের পাখি ডাকে। আমি বলে বুঝাতে পারবোনা সেটা কেমন,ঠিক যেমন বলে বুঝাতে পারবোনা সেটা হাসি নাকি কান্না সুখ নাকি বিরহ।

আব্বুর বকাঝকার ফলশ্রুতি তে নৌকায় চড়া কম হয়েছে। তবুও,শেষ বিকালে একবার নৌকায় চড়েছিলাম। খুব বড় হইনি তখনো। দু’টো জিনিস আমার ইন্দ্রিয়জয় করছিলো। শান্ত বিকালে বৈঠার সাথে পানির যুদ্ধের আওয়াজ আর ততটাই শান্ত ভাবের নদীর পাড়ের মাটির গন্ধ। আর কোনো কথা ছিলোনা। আচ্ছা,এইটা কি সুখ ছিলো নাকি এই জমিনের হাজারটা দিনের চেপে রাখা কষ্টের অল্প রকম আভাস।

ছোটবেলার কথা মনে পড়ছে। যখন দাদী বাড়িতে যেতাম, বিশেষত ঈদে তখন ঠান্ডার সময় থাকতো। আঙিনায় এক পাশে হেঁসেল বা রান্নাঘর ছিলো। দাদী চিতাই বা ভাপাপিঠা বানাতেন। রান্নাঘরের উপরে লম্বা পাইপ দেয়া থাকতো। হ্যাঁ,এই ব্যাপারটা western. তো,সেই পাইপ দিয়ে ধোঁয়াগুলো কালচে হয়ে বের হয়ে যেত স্বাভাবিকভাবেই। অন্যরা সেই খোঁয়ার চোটে কাশিকে নিজের সংগী বানাতো ঠিকই,কিন্তু আমি তার মধ্যে এক ধরনের গন্ধ পেতাম। সেই ধোঁয়ায় একটা সুখ লাগতো,একটা নেশা লাগতো। মনে হতো,আমি প্রতিদিন সেই বিকাল-সন্ধ্যার মধ্যের সময়ে এই ধোঁয়া শুঁকতে থাকি নেশাখোরের মতো। আচ্ছা,এই কালো খোঁয়া কি আমাকে আসলেই সুখ দিয়েছিলো নাকি আমার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছিলো বিরহ ইন্দ্রিয়?

আর একটা অতীত স্মৃতিতে ডুবতে চাইছি। ঢাকায় যেখানে থাকি সেখানে,৭ তলায় আমার বসবাস। Ground floor এ এই ভবনের বাচ্চারা খেলতে থাকে,চিতকার করে। এই চিতকার যেন একেকটা time machine এর ভূমিকায় অবতার হয়। আমাকে আমার ছোটবেলাতে নিয়ে যায়। আমি অনেক আদরের ছিলাম। বাসার সীমারেখার বাইরে ছোটবেলায় খেলার সুযোগ কম হয়েছে। তবে,মাঝে মাঝে যখন কোনো আত্মীয়র বাসায় যেতাম তখন লাগামহীন ঘোড়া ছিলাম। এমনি একজনের বাসার সামনে মাঠ ধরনের ছিলো। আমি শুনেছি,চাঁপাই নবাবগঞ্জ এমন একটা জেলা যেখানে মেয়ের সংখ্যা বেশী। এই অপ্রমাণিত তথ্য আমার বিশ্বাস হয়েছে। I am brought up with girls. অনেক লাজুক ধরনের ছিলাম। কিন্তু,ঘুরে ফিরে বেশীর ভাগ খেলতে হতো ওই আপু বা X Y এর সাথেই। তো,এমনি এক বিকাল সন্ধ্যার মধ্যের সময় ছিলো। যাদের বাসায় গেছি,সেও মেয়ে। আমার আজও মনে আছে,তার লাল একটা ফ্রর্ক ছিলো পড়া ছিলো তার পেছনে মাজার উপরে দু’টো ফিতা ছিলো। ওই যে থাকে না,ফ্রর্কটা টাইট করার জন্য। তো,আমি লজ্জায় কাহিল। সে বারবার তার এলাকার খেলার বন্ধুদের সাথে আমাকে মেশানোর চেষ্টা করছে। এখন ভাবলে আমি বুঝি,কত টা বেকুব ছিলাম। অনেক কষ্টে খেলতে নামলাম ‘বরফ পানি’ নাম এর বিখ্যাত খেলা। আমার মনে আছে,সেই মেয়েটা দৌড়াচ্ছিলো। এতো জোরে দৌড়াচ্ছিলো যে তার ফ্রর্ক এর ফিতা দুইটা উড়ছিলো। ছোট ফিতা বলে বেশী উড়তে পারছিলোনা ঠিকই। কিন্তু,আমার চোখে তা লেগেছিলো। এই জিনিসটা আমার মধ্যে এক ধরনের মোহ সৃষ্টি করেছিলো। আমার পা আটকিয়ে গেছিলো। একই সাথে কানে আসছিলো ওই পাখির আওয়াজ আর সন্ধ্যে বেলার মখমল ধরনের অদ্ভুত গন্ধ। কেউ আমাকে মোহের মধ্যে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। আমার স্পষ্ট মনে আছে। আমি ঘাসের উপর পড়ে ছিলাম। আর সেই ঘাস আর মাটির ছোঁয়া আমাকে বাধ্য করছিলো আমি যেন তাদের সাথেই মিশে যায়,সেখানেই যেন শুয়ে থাকি। বিশ্বাস করুন,আমার উঠতে ইচ্ছা করেনি। আচ্ছা সেই লাল ফিতা আর এই বেনামি মোহ কি আমাকে সুখ খুঁজে পাওয়ার ঠিক নির্দেশনা দিয়েছিলো,নাকি এটি ছিলো বারবার পড়ে যাওয়া দু:খের বার্তা?

আমি স্থিরতা অনুভব করছি,বাইরে যতটা স্থিরতা ভেতরটা ঠিক ততটাই অস্থির। আমি ফেরত যেতে চাই,উত্তর খুঁজতে।

কে হুমায়ূন? (Who is Humayun)

কে হুমায়ূন? (Who is Humayun)

Rajiul Huda Dipto is a professional screenplay writer and working for years in the Bangladeshi TV industry. Besides that, he introduces himself as a photographer, whose photographs have been featured in various magazines and exhibitions all around the world. Not regularly, but he publishes his works in national dailies as well. Currently, he is working as a community writer in BuzzFeed and a contributor in Getty Images.

দিন আসে, দিন যায়। আমি শুধু চুপ থাকি। ইদানিং কিছু বিষয় আমার আশেপাশে, আমার নিউজ ফিডে আমার প্রতিদিনের জীবনে আমার ইন্টারেস্ট না থাকা সত্ত্বেও প্রবেশ করছে। অদ্ভুত এক টুপি আকৃতির চুল ধারী লোকের হোয়াইট হাউসের গদি হরণ, শুধু মাত্র একটা সেলফি বা না গিয়েও চেক-ইন বা “আমি গান বুঝি, সংস্কৃতি বুঝি” ধরনের কিছু হাতে গোনা লোকজনের লোক দেখানো ফোক ফেস্ট নিয়ে প্রতিদিনকার সমালোচনা আর এইচডি টিভিতে ঝিরঝিরে আবছা ক্যামেরায় ধারণ করা বিপিএল এর লাইভ টেলিকাস্ট এইসবের কিছুই আমাকে গ্রাস করেনি।

আমি ভাবছি, আমিকি এতোটাই বোরিং হয়ে গেছি নিজের দুনিয়ায় থাকতে থাকতে? না কি, মানুষের যাতে ইন্টারেস্ট বেশী সেখানে আমার ইন্টারেস্ট কম? এইসবের উত্তর নিয়ে পরে লেখা যাবে। এইবার আমি আসল কথায় আসছি।

The Book Cover of ‘মিসির আলি! আপনি কোথায়?’

হুমায়ূন আহমেদ পড়া শুরু করেছিলাম আম্মুর হাত ধরে। আম্মুর বইয়ের প্রতি দুর্বলতা বেশী। তার কালেকশন সত্যি দারুণ। প্রথম বই, “মিসির আলি আপনি কোথায়?” নামটা লিখার সময় আমার গায়ে এখনো কাঁটা দিচ্ছে, সত্যি দিচ্ছে। না, ভূতের গল্প না। কিন্তু, সেইরকমই। সে সময় আমরা ভাড়া বাসাতে থাকতাম। আমি বড় মামার সাথে ঘুমাতাম। সেই বাসায় আমাদের ঘরের পাশে লম্বা বারান্দা ছিলো। রাতে মামা ঘুমাতো, আমি বইটা পড়তাম। সাদা সেই কভারটায় লাল রঙা টেলিফোনের ছবি। গল্পের প্রধান ফিমেইল প্রোটাগোনিস্ট একটু অলৌকিক। মনে হতো সে লম্বা বারান্দা দিয়ে হেঁটে এসে দরজাটা ফাঁক করে বলবে, “আমাকে কি আয়নাতে দেখা যায়?” সেই থেকে হুমায়ূন প্রেম শুরু। সেটা আজ অবধি আছে।

কিন্তু, ইদানিং কালে আমি কষ্ট পাই হুমায়ূন আহমেদের নাম শুনলে বা তার প্রসঙ্গ উঠলে। ভার্সিটি তে একদিন ক্লাসে হুমায়ূন আহমেদ প্রসঙ্গ উঠলো। শিক্ষক মশাই টেকনিকালি হুমায়ূন আহমেদ এর তুলোধোনা করলেন। আমি বললাম, “বলে কি?” পাশের জন দেখলাম খুব সায় দিচ্ছে শিক্ষকের কথায়। বললাম, “তুমি হুমায়ূন আহমেদ পড়না?” সে তার মুখ বাঁকা করে উত্তর দিবো, “ইয়ু, না।” আমি অবাক হয়ে তাকালাম। সে আমার বয়সী, কিংবা একটু ছোটই হবে। তার মতো সৃজন মনা একজনের কাছ থেকে এইটা আশা করিনি। কষ্ট তার “না” বলাতে লাগেনি। কষ্ট লেগেছে, তার সাত জনমের বাঁকা মুখ দেখে। কষ্ট শিক্ষক মশাই এর হুমায়ূন অপ্রীতি তে লাগেনি। কষ্ট লেগেছে, উনার “হুমায়ূন আহমেদ বাংলা লিটারেচারে কি করেছেন?” মূলক প্রশ্ন থেকে। হুমায়ূন আহমেদ বেঁচে থাকতে আমার বয়সী যেসব পাঠক তার নাম জমতে জমতে মুখে ফেনা তুলতো, তারা যখন আজ উনি মারা যাবার পর বর্তমান সময়ে “আমার ভিনদেশী তারা” এর মতো “আমার ভিনদেশী লেখক” নিয়ে মাতামাতি করে নিজেকে স্মার্ট সাজাতে ব্যস্ত তা দেখে আমার কষ্ট লাগে।

Google Doodle on Humayun Ahmed’s 69th Birthday

“ধুর, হুমায়ূন আহমেদ পড়িনা”, “ইয়ু, হুমায়ূন পড়ি না”, এইসব বাক্য কি ইদানিং নিজেকে স্মার্ট প্রমাণ এর পন্থা? লাস্ট সেমিস্টারেও যখন সকালের ঘুম বাদ দিয়ে ভার্সিটি যেয়ে এক শিক্ষকের মুখে হুমায়ূন আহমেদ কে তুলোধোনা হতে শুনতাম কষ্ট লাগতো। হ্যাঁ, জেনারেশন পাল্টালে রুচি পাল্টাতে পারে কিংবা একই জেনারেশন এর কাল বিশেষে রুচি পাল্টাতে পারে। কিন্তু, শিক্ষক তাও আবার লিটারেচার এর শিক্ষক দের কাছে এই ধরনের রেসপন্স আমি চিন্তা করিনি। শিক্ষক বলেই যে হুমায়ূন আহমেদ ভালো লাগবে, এইটা অবশ্যই কম্পালশারি না। কিন্তু, এমন যুক্তি? এর থেকে তো পার্শ্ববর্তী দেশের “আনন্দবাজার” হুমায়ূন আহমেদের গুণ বেশী গায়। গুণীর কদর এর ক্ষেত্রে আমরা বরাবরই আনাড়ি। দাঁত থাকলে দাঁতের মর্ম যেমন বুঝি না, দাঁত চলে গেলেও মাঝে মাঝে তার মর্ম বুঝি না।

Himu Illustration. Source: Internet

আমাকে শুনতে হয়, লেখালেখির অভ্যাস কখন থেকে। আমি কখনো সত্যি উত্তর টা দিই না। শুধু বলি, “এই হবে হয়তো। এইসব তো বলে কয়ে আসে না, শুরু করেছি হয়ে গেছে।” কিন্তু না। আসল উত্তরটা অন্যখানে। আমার লেখালিখির রসদ জগিয়েছেন আমার মা। বাচ্চারা পায়ের উপর বসে ঝুলার একটা খেলা খেলে। যিনি পা দিয়ে তুলেন, তিনি বলেন “দোল দোল দোলনি, রাঙা মাথায় চিরুনি।” কিন্তু, আম্মু গায়তো আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো। আম্মু যখন, “ছেলে হারা শত মায়ের অশ্রু” বলে আমার দিকে তাকাতো সেই কষ্ট যেনো আমি বুঝতে পারতাম। তারপর, রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলের আগমন। ভোরে লাল সোয়েটার, সাদা শার্টের নিচে সবুজ প্যান্ট পড়ে যখন স্কুলের পিটি করতে যেয়ে চোখ ছলছল অবস্থায় জাতীয় সংগীত গাইতাম তখন স্কুল মাঠের আম গাছ গুলা থেকে বেরিয়ে আসা কাষ্ঠ রসের গন্ধ আর জাতীয় সংগীতের লাইন আমাকে রবীন্দ্রনাথ কে চিনিয়েছে। আমার এক কাজিনের বাসায় গানের শিক্ষক আসতেন। তারা কয়েকজন হারমোনিয়াম নিয়ে বসতো। একটা খাতায় লাইন লেখা ছিলো, “চল চল চল। উর্দ্ধ গগনে বাজে মাদল।” তারা আমার সামনে গায়তে লজ্জা পেতো। আমি তাই গানটা পড়ে নিয়ে, নিজে থেকে আড়ালে গাইতাম। সেই থেকে নজরুলের আবর্তন। আর, তারপর হুমায়ূম আহমেদ। আব্বু একবার গল্প শুনিয়েছিলো, তিনি কিভাবে বর্ষার সময় গ্রামের কাঁদা রাস্তা পাড়ি দিয়ে রাতের বেলা বাড়ি থেকে পালিয়ে “আজ রবিবার” “বকর ভাই” দেখতে যেতেন। সেই থেকে আমার ইন্টারেস্ট। হুমায়ূন আহমেদ আমাকে শিখিয়েছেন।

প্রশ্ন আসবে, কি শিখালেন এই লোকটা। যে নাকি বাংলা লিটারেচার এ কি করেছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠে। এমন লোক, সত্যি কি কিছু শিখাতে পারে? প্রশ্নকর্তা বলবেন, “নিছক মনোরঞ্জন ছাড়া আর কিছু থাকলে বলবেন। মানে হচ্ব্যছে, ব্যক্তিগত জীবনের মনোরঞ্জন আরকি।” আমি মৃদু হেসে বলবো, “দাঁত খিলানো বন্ধ রেখে কথা শোনেন।” আমাকে বিশাল বিশাল বাক্যে অনুভূতি না লিখে কিভাবে সোজা ভাবে ছোট বাক্যে অনুভূতি প্রকাশ করতে হয় তা শিখিয়েছেন, শীতে কাঁথা মুড়ি দিয়ে আঁটসাঁট ভাবে শুয়ে গল্পের বই পড়তে শিখিয়েছেন, ভোরে খেঁজুর গাছের নিচে বসে খেঁজুর রস খাওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছেন, ঝরঝরে গরম ভাত ঘি দিয়ে আরাম করে কিভাবে খেতে হয় তা শিখিয়েছেন, ঝুঁটি বাঁধা মেয়ের সাথে প্রেম, খোলা ছাদে জোছনা দেখা আর সাপ তাড়ানোর ঔষধের নাম শিখিয়েছেন, বোন আর মায়ের মধ্যে মমতার কোনো পার্থক্য নাই সেটা আমার মাথায় ঢুকিয়েছেন, আমাকে পাঞ্জাবি পড়তে শিখিয়েছেন, সুন্দর মানে কালো হয় সুন্দর মানে ইংরেজিতে কথা বলা নয়, সুন্দরতা থাকে ক্ষুধার্ত মানুষের এক প্লেট বিরিয়ানি খেতে দেখার মধ্যে উনি আমাকে তা বুঝিয়েছেন। আর শিখিয়েছেন সব চেয়ে অমূল্য শিক্ষা। নিজের স্বপ্নের পেছনে দৌড়ানো। যা তুমি, তা হতে পারা টা। কেমিস্ট্রির গাছ হয়েও যে, পেশায় লেখক হওয়া যায় উনি তা শিখিয়েছেন।

কাউকে জোর করে হুমায়ূন প্রেমিক বানানো আমার ইচ্ছা না। যে বলুক যা ইচ্ছা। হুমায়ূন আহমেদ আমাকে বাংলা গল্পের বই হাতে নিতে শিখিয়েছেন। আমি স্মার্ট না হলাম। আমি জানি আমি কি। নিজের মহত্ব নিয়ে গর্ব করতে যিনি শিখিয়েছেন, আজ তার জন্মদিনে তাকে স্মরণ করছি। এরা না বুঝলেও, আমার মতো বোরিং কিসিমের মানুষ আপনাকে বোঝে। ভালো থাকুন। আল্লাহ্‌ আপনাকে জান্নাতবাসী করুক, আমিন।

ইফতারি খুব বেশী আবেগী (Impulsive Iftari)

ইফতারি খুব বেশী আবেগী (Impulsive Iftari)

Rajiul Huda Dipto is a professional screenplay writer and working for years in the Bangladeshi TV industry. Besides that, he introduces himself as a photographer, whose photographs have been featured in various magazines and exhibitions all around the world. Not regularly, but he publishes his works in national dailies as well. Currently, he is working as a community writer in BuzzFeed and a contributor in Getty Images.

যারা টিনএজ বয়সে আছেন, বা যারা তার থেকে একটু বেশী, বা যারা আর কিছুটা বেশী তাদের মধ্যে যারা পরিবারের সাথে বসবাস করেন কিন্তু এই বসবাস এক ঘেয়েমি লাগছে অথবা কিছু একটা করতে চান তাই বাড়ি ছেড়ে দূরে পাড়ি জমানোর স্বপ্ন দেখছেন কিংবা উপায় নাই তাই দূরে যাবেন তাদেরকে বলি।

বাড়ি ছেড়ে দূরে থাকার কষ্ট, যাদের সাথে আপনার জীবনের এতটা সময় একসাথে বসে ইফতারি করেছেন তাদেরকে ছেড়ে ইফতারি করার কষ্ট যদি উপলব্ধি করতে চান তবে এই মাসে বাড়ি থেকে দূরে থাকুন।

ইফতারির দুই-তিন ঘন্টা আগে থেকে বাসার রান্নাঘরে একটা উত্তাপ ছড়িয়ে পড়তো। নাকে একটা ঝাঁঝ লাগতো, যা হয়তো ক্ষুধা বাড়াতো কিছুটা। ছোট শহরে থাকার কারণে দেখেছি, ইফতারির ঠিক আগের সময়টাতে রাস্তায় নেমে আসতো দুনিয়ার একাকীত্ব। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাতল করতাম, আমি ছোট ভাইয়া আর বড় মামা। তারপর, আব্বুর আসার অপেক্ষা। তারপর, ইফতারি টেবিলে বসা। তারপর, আযান শোনার প্রচেষ্টা।

বাসায়, আজো হরেক রকম আইটেমের ইফতারি ভাজা হয়, আজো অপেক্ষা করা হয় কিন্তু একটা চেয়ার খালি থাকে। আম্মুকে খুব মিস করি। আম্মু যখন ইফতারিতে খাবার বাড়ে, দেখতে দারুণ লাগে তাইনা বলুন?
কখনো আর সম্ভব হবে কিনা জানিনা, কিন্তু আমি স্বপ্ন দেখি ত্রিশটা দিন আবার সবার সাথে বসে ইফতারি করার। স্বপ্ন দেখি, ভার্সিটি থেকে ছুটি পাবার।